‘সবচেয়ে বেশি গর্ব করি ১০২ বার ৫ উইকেট পাওয়ায়’

৪০০ টেস্ট উইকেট নেওয়া প্রথম বোলার, এক সময়ের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। আশির দশকের চার গ্রেট অলরাউন্ডারের একজন। বলা হয়, একাই একটা দলের ভাগ্য নির্ধারণ তার মতো করে কেউ করতে পারেনি ক্রিকেট ইতিহাসে। খেলোয়াড়ি জীবনেই নাইটহুড পাওয়া একমাত্র ক্রিকেটার। খেলা ছাড়ার পর ছিলেন নিউ জিল্যান্ডের প্রধান নির্বাচক, ছিলেন নানা ভূমিকায়। এখন নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের বোর্ড সদস্য। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের প্রথম দিনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে স্যার রিচার্ড হ্যাডলি খুলে দিলেন মনের দুয়ার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2017, 09:36 AM
Updated : 20 Jan 2017, 12:23 PM

এই শহরেই আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা। কিংবদন্তি হয়ে বেড়ে ওঠার সময়টা কেমন ছিল?

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি: বলতে পারেন এই মাঠে খেলেই ক্রিকেটার হিসেবে পোক্ত হওয়ার শুরু। মাঠে তাকিয়ে দেখুন, আগে এখানে ছয়টা পিচ ছিল। দুটি সিনিয়র গ্রেড টুর্নামেন্ট হতো, প্রেসিডেন্টস গ্রেড ও সেকেন্ড গ্রেড। বলতে গেলে গোটা ক্লাব ক্রিকেট ক্যারিয়ার আমরা এখানেই খেলেছি। বলতে পারেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রস্তুতির জন্য এটা ছিল নার্সারির মতো। ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের পরিবারের যে সম্পৃক্ততা, সেটির বড় অংশ জুড়ে আছে এই হ্যাগলি ওভাল। আমার জন্য, আমাদের জন্য এটি স্পেশাল একটি জায়গা।

আপনার জীবনে তো বাবা ওয়াল্টার হ্যাডলির ভূমিকা অনেক বেশি। ১৯৪৯ সালে নিউ জিল্যান্ডের ইংল্যান্ড সফর, যেটিতে আপনার বাবা ছিলেন অধিনায়ক, শোনা যাচ্ছে সেই সফর নিয়ে দারুণ একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন?

হ্যাডলি: লোকে আমার অবদানের কথা বলে। অথচ নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে আর যে কারও চেয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার বাবার। যুদ্ধের আগে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথমবার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। খেলেছেন যুদ্ধের পরও। ১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে ছিলেন অধিনায়ক। ১৯৫১ সালে অবসরের পর নির্বাচকের দায়িত্ব নেন। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান সফরে ছিলেন দলের ম্যানেজার। পরে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের বোর্ডে ছিলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। বোর্ডের আজীবন সদস্য তিনি।

এসবের বাইরে পরিবারেও নজর দিয়েছেন। ক্রিকেটার হিসেবে আমাদের ভাইদের বেড়ে ওঠা, গড়ে তোলায় ছিল তার ভূমিকা । আমিই শুধু নই, আমার ভাই ব্যারি ১৯৭৫ বিশ্বকাপে খেলেছেন, ডেইল খেলেছেন ২৬টি টেস্ট। সব মিলিয়ে আমরা ক্রিকেটীয় পরিবার। খেলাটায় আমার বাবার অবদান অসাধারণ।

১৯৪৯ সালের এই সফর ছিল আট মাসের। আমার বাবা প্রতিদিনই ডায়েরি লিখেছেন। এটি হয়ে আছে খুবই বিশদ ও ঐতিহাসিক একটি দলিল, যা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বাবা আজ নেই। ভাইদের সহায়তায় আমি বাবার ডায়েরিটি বই আকারে বের করার উদ্যোগ নিয়েছি, নাম ‘দ্য স্কিপারস ডায়েরি’। আমরা বাবাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে চাই। চাই নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রতি তার অবদানকে সম্মান জানাতে। বাবার গল্প দিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের নিয়ে যেতে চাই সেই সময়ের দিনগুলিতে। পুরো সফরটাকে উপস্থাপন করতে চাই অধিনায়কের চোখে। সে সফরে যাওয়া সব ক্রিকেটারের প্রতিও সম্মান জানাতে চাই।

বাবার ডায়েরি অবশ্যই স্পেশাল, তবে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের ইতিহাসেও তো সফরটি বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে..

হ্যাডলি:
নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের আর কোনো দল তাদের খেলার বছর ধরে পরিচিত হয়ে নেই। ১৯৪৯ সালের সফরের দল বলতেই লোকে জানে সাটক্লিফ, রিড, ডনেলি, হ্যাডলি, বার্টনসহ দলের সবার কথা।

বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছে আমার ভাই। সুরটা বেঁধে দিতে আমি লিখেছি সূচনা। বাবার ডায়েরি গোটা বইয়ের চুম্বক অংশ। এর বাইরেও থাকছে স্কোরকার্ড, পরিসংখ্যান, শখানেক ছবি। দলের সবার স্বাক্ষর করা সফরের চুক্তিনামা থাকবে। সফর নিয়ে ম্যানেজারের প্রতিবেদন, যাতে আছে ভালো-খারাপ সবকিছু, এসবও থাকবে। সফর শেষে ক্রিকটাররা যা করেছেন, সেসবও।

ওই ডায়েরির বিশেষ কোনো কিছু বা কোনো অংশ কি পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায়?

হ্যাডলি: ‘ডমিনিয়ন মোনার্ক’ নামের একটি জাহাজে করে সফরে গিয়েছিল দলটি। ওয়েলিংটন থেকে সিডনি, মেলবোর্ন, পার্থ, ডারবান, কেপ টাউন, ক্যানারি আইল্যান্ড হয়ে সাউথ্যাম্পটনে গিয়েছিল দল। যেতে লেগেছিল ৩৭ দিন।

গোটা সফরে ৩২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিল দল। হেরেছিল মাত্র একটিতে। জিতেছিল ১৩টি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার টেস্টের সবকটি ড্র করতে পেরেছিল, যেটি ছিল অভাবনীয় সাফল্য। এর আগে সফরে যাওয়া আমাদের সব দল হেরে এসেছে।

আগের দুটি সফরে যাওয়া দল আর্থিকভাবেও লোকসানের শিকার হয়েছিল। আর এই সফরটি নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখেছিল। ১৬ হাজার ৭০০ পাউন্ডের মত, ওই যুগে এটা বিশাল অঙ্কের টাকা। নিউ জিল্যান্ডের ভবিষ্যত সফর ও দেশে খেলা আয়োজনের জন্য অর্থের জোগান এসেছিল ওই টাকা থেকে।

তখন যুদ্ধ থেমে গেছে, ইউরোপে চলছে পুনর্গঠন। লোকে রেশন নিত, কুপন দিয়ে খাবার নিতে হতো। অধিনায়ক হিসেবে বাবা এসব যা দেখেছেন এবং যেসব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, বক্তৃতা যা দিয়েছেন, সবই থাকছে বইয়ে। এমনকি ডিউক অব এডিনবরা, রয়্যাল হাইনেস ফিলিপের একটি বার্তাও আছে। তিনি তখন এমসিসির প্রেসিডেন্ট, চারবার দলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

সম্মিলিত বাহিনীর বিপক্ষে জার্মানিতে একটি দুই দিনের ম্যাচ খেলেছিল দলটি। এছাড়াও বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন, সামাজিক অনুষ্ঠান, লাঞ্চ, ডিনার, ক্রিকেট ব্যাটের কোম্পানি, যেসব জায়গায় তারা গিয়েছেন, যা করেছেন, সবকিছুরই বিশদ দলিল আছে।

তিন বছরের প্রকল্প এটি। অন্য আর সব উদ্যোগ থেকে এটি আলাদা আরেকটি কারণেও। আমরা দুই ঘণ্টার একটি ডিভিডিও বানাচ্ছি, এই সফরের সত্যিকার ফুটেজ দেখে। সফরের সাতজন ক্রিকেটারের ইন্টারভিউ আছে, যা নেওয়া হয়েছিল পরে।

বাবার কোন কথা, পরামর্শ কি ছিল যা আজও আপনার মনে গেঁথে আছে?

হ্যাডলি: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে কথাটি তিনি আমাকে, অনুমান করতে পারি আমাদের চার ভাইকেই বলেছেন যে, “যা কিছুই করো রিচার্ড, নিজের পারফরম্যান্সে গর্ব অনুভব করো, সেরাটা দাও। কেউ যদি তোমার চেয়ে ভালোও করে, নিজের শতভাগ দেওয়া মানে কেউ তোমার সমালোচনা করতে পারবে না।”

এই গর্বই ছিল আমার অনুপ্রেরণা ও চালিকাশক্তি। সবকিছু ঠিকঠাক করা, প্রস্তুতি ভালো নেওয়া, ট্রেনিংয়ে ঘাম ঝরানো যেন মাঠে ভালো পারফরম্যান্সের সুযোগটা বেশি থাকে।

আরেকটা কথা তিনি খুব বলতেন, “যদি ক্রিকেটারের মতো হতে না পারো, অন্তত দেখতে যেন ক্রিকেটারের মতো লাগে।” অন্যভাবে বললে, পোশাক-পরিচ্ছদে যেন পরিপাটি থাকে। অনুশীলনেও যেন ম্যাচের মতো সাদা পোশাক গায়ে থাকে।

তিনি ছিলেন অনেকটা ঐতিহ্যপ্রিয়। অনুশীলনে, নেটেও সাদা পোশাক গায়ে চাপাতে বলতেন। যেন খেলাটাকে আরও ভালো করে অনুভব করা যায়, এটার অংশ হওয়া যায়। সেটি পারলে মাঠেও ভালো পারফরম্যান্সের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

আপনি কি বাবার পথই অনুসরণ করেছেন?

হ্যাডলি: বাবা সবসময়ই নিখুঁত প্রস্তুতিতে বিশ্বাস করতেন। পরিবারের আমরা সবাই বাড়ির আঙিনায় অনুশীলন করতাম। নেট ছিল, পিচ ছিল, ক্রিকেট সরঞ্জাম তো ছিলই। একসঙ্গে আমরা ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন করতাম। বাবার সবসময়ই আগ্রহ ছিল আমরা কি করছি, কেমন করছি। প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি স্কুলে খেলি বা ক্লাবের হয়ে, ক্যান্টারবুরি বা নিউ জিল্যান্ডের হয়ে, সবসময়ই চাইতেন আমরা যেন ভালো করি।

ডেইল (বড় ভাই) যখন ১৯৬৯ সালের ইংল্যান্ড সফরে নিউ জিল্যান্ডের ক্যাপ ও সোয়েটার পেল, আমি চেয়েছি পরের ইংল্যান্ড সফরেই (১৯৭৩) যেন আমিও পাই। নিজেদের মধ্যে ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল বড় অনুপ্রেরণা।

ডেইল চার উইকেট পেলে, আমি পাঁচটা পেতে চাইতাম। সে সাত নম্বরে ব্যাট করে রান করলে, আমি আটে ব্যাট করে চাইতাম আরও বেশি রান করতে যেন পরের ম্যাচে সাতে খেলতে পারি। লড়াইটা আমাদের পারফরম্যান্স আরও ভালো করতে সহায়তা করত; দিনশেষে লাভ হতো দলের।

ডেইলের সঙ্গে ক্যান্টারবুরির হয়ে আপনার বোলিং জুটি ছিল দারুণ। কিন্তু নিউ জিল্যান্ডের হয়ে তো তার ক্যারিয়ার এতটা লম্বা হলো না…

হ্যাডলি:
আমার ক্যারিয়ারে ওর প্রভাব অনেক। ওর যা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, পরে তো সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলিং কোচ হয়ে উঠল।

হয়তো মিড অফ বা মিড অনে দাঁড়িয়ে বলল, “রিদম ঠিকঠাক পাচ্ছো না, তাই না?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, একটু ধুঁকছি…।” সাথে সাথে হয়ত সে বলত, “সামনের পা এখনকার চেয়ে আরেকটু দ্রুত নীচে নামাও, যাতে পা ফেলার সময় ভিত্তিটা থাকে এবং শরীরটা সাপোর্ট পায়।”

তো এই ধরনের ছোট ছোট টিপস অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিত। আমি সবসময় ওকে পাশে পেয়েছি, ওর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ওর সমস্যাও অনেক সময় আমি বুঝতে পারতাম।

অবধারিত প্রশ্ন; সমসাময়িক অন্য তিন গ্রেট অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম, কপিল দেব ও ইমরান খানের সঙ্গে ওই সময়টায় নিয়মিত যোগাযোগ হতো? পরস্পরের পারফরম্যান্সের খবর রাখতেন?

হ্যাডলি: ওই যুগটা ছিল স্পেশাল। আমরা জানতাম কে কোথায় কেমন করছে। পরস্পরের পারফরম্যান্সের খোঁজ রাখতাম। কে কত উইকেট নিচ্ছে, কত রান করছে, এসব জানতাম। পরস্পরের বিপক্ষে খেললে, ভালো করার তাগিদ বেড়ে যেত। ব্যাটিং, বোলিং পারফরম্যান্সে প্রতিপক্ষ অলরাউন্ডারকে হারিয়ে দেওয়ার তাগিদ থাকত। ব্যক্তিগত এই লড়াইয়ে যে ভালো করত, ম্যাচ বা সিরিজের ফলেও সেটার প্রভাব থাকত।

পরস্পরের প্রতি আমাদের ছিল প্রচণ্ড শ্রদ্ধা। একে অপরের স্কিলকে আমরা সমীহ করতাম, সম্মান জানাতাম। আমরা অনেকটা একইরকম ছিলাম, তবে আমি একটু বেশি বোলিং অলরাউন্ডার। বিফি (বোথাম) ছিল প্রায় পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার, ইমিও (ইমরান) অনেকটা তাই। আমি একটু পিছিয়ে ছিলাম ব্যাটিংয়ে।

নিউ জিল্যান্ডের হয়ে শুরুর দিকে আমি ১০-১১ নম্বরে ব্যাট করতাম। অভিষেক টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমি ৮৮ রানে ২ উইকেট (আসলে ৮৪ রানে) পেয়েছিলাম, রান করেছিলাম ৪৬। এরপর বাদ পড়ে যাই। এদিক থেকে ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে আমার মিল আছে। দুজনই প্রথম টেস্টের পর বাদ পড়েছি!

শুরুতে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলাম, দলে থিতু হতেই ৪-৫ বছর লেগে যায়। এরপরই সাফল্য পেতে শুরু করি, খেলায় ধারাবাহিকতা আসে।

আমার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ায় বড় ভূমিকা ছিল কাউন্টি ক্রিকেটে খেলাটা। ১৯৬৮ সালে খেলতে যাই নটসে, ক্লাইভ রাইসের মতো গ্রেটদের সঙ্গে খেলেছি। আমাকে আরও ভালো ক্রিকেটার হতে সাহায্য করেছে এটি। আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন সম্ভবত কাউন্টি ক্রিকেটে ডাবল। ১৯৮৪ সালে ডাবল করেছিলাম, ১৯৮৭ সালেও কাছাকাছি এসেছিলাম। রান করেছিলাম ১ হাজার ১০০; কিন্তু উইকেট একশর চেয়ে তিনটি কম ছিল।

পরিসংখ্যান-প্রিয় হিসেবে আপনার পরিচিতি ছিল…

হ্যাডলি: সত্যি বলতে, পরিসংখ্যান আমাকে দারুণ প্রভাবিত করত। এর জন্য সমালোচনাও শুনতে হয়েছে অনেক। তবে আমার ভেতর থেকে সেই পারফরম্যান্সটা বের করে আনতে এর প্রয়োজন হতো; সেটিই ছিল আমার অনুপ্রেরণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আমার ক্যারিয়ারে পরিসংখ্যান পাতায় যত অর্জন, আমাকে সবচেয়ে বেশি গর্বিত করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০২ বার ৫ উইকেট নেওয়া। ৫ উইকেট মানে সেঞ্চুরির সমান, কাজেই এটি একশ সেঞ্চুরির মতোই!

গর্বের কারণটা হলো, এই পরিসংখ্যান বলছে, আমি দারুণ ধারাবাহিক ছিলাম ও নিজের কাজটা করেছি। এটিই আমার কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটসম্যানরা রান করবে, সেঞ্চুরি-ডাবল সেঞ্চুরি করবে। কিন্তু আমার কাজ তাদের মনে ভীতি ছড়ানো, আউট করা, এমনকি তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করা। আমি যখন কোনো ব্যাটসম্যানকে আউট করব, সে ব্যর্থ হবে বারবার, তার ক্যারিয়ার তো ধ্বংস হবেই। নতুন বলের বোলার হিসেবে নিজের কাজটাকে সেভাবেই দেখতাম আমি। ক্যারিয়ারটা ভালোই ছিল আমার!

ক্যারিয়ারের শেষটাও তো ছিল স্বপ্নের মত, শেষ ইনিংসে ৫ উইকেট, ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট…

হ্যাডলি: হ্যাঁ, দারুণ ছিল। শেষ বলে উইকেট… ডেভন ম্যালকমের (১১ নম্বর ব্যাটসম্যান) উইকেট, গোণায় ধরা হবে তো নাকি?

অবশ্যই ধরা হবে, উইকেট তো উইকেটই। কিন্তু মনে হয় না, আরও কিছুদিন খেলতে পারতেন?

হ্যাডলি: নাহ, ৩৯ বছর বয়স তখন। মধ্য তিরিশেই বেশিরভাগ ফাস্ট বোলার খেলা ছেড়ে দেয় বা অতটা কার্যকর থাকে না। আমার রান আপ ছিল ছোট। ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চারের ব্যাপার ছিল না। ওইটুকতেই সবকিছু। শরীরের ওপর চাপ কম পড়েছে। এটাই আমার ক্যারিয়ারকে দীর্ঘায়িত করেছে।

অনেকের মতেই, রিচার্ড হ্যাডলি ও ম্যালকম মার্শাল সর্বকালের সবচেয়ে পরিপূর্ণ দুই ফাস্ট বোলার…

হ্যাডলি:
উমমম…কিছুটা আলাদা ছিলাম আমরা। তার অ্যাকশন ছিল খানিকটা ক্ষিপ্র। সুইং করাতে পারত, আমার চেয়ে একটু দ্রুতগতিরও ছিল। আমি ছিলাম অনেকটা পরীক্ষা নেওয়ার মত বোলার, ধরুন গ্লেন ম্যাকগ্রার ঘরানার। বাউন্সারে ব্যাটসম্যানদের চমকে দিতে পারতাম বটে, তবে কখনোই অতিরিক্ত দিতাম না। বাউন্সারে খুব বেশি স্কিলের ব্যাপার আছে বলেও মনে করি না।

আমার স্কিল ছিল বল দুই দিকেই সুইং করানো, সিম করানো এবং ব্যাটসম্যানদের লেংথে পরাস্ত করা। বিভিন্ন পিচে, বিভিন্ন উচ্চতার ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে সেটি বিভিন্ন রকম হতো। তাদেরকে খেলতে বাধ্য করা এবং ব্যাটের কানা নেওয়া। আমার বেশিরভাগ উইকেটই তাই কিপারের কাছে, স্লিপে, গালিতে।

ক্যারিয়ারে কোন ব্যাটসম্যানকে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে?

হ্যাডলি: সব ব্যাটসম্যানই চ্যালেঞ্জিং। এমনকি ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানকে আউট করাও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। সত্যিই বলছি, কারণ তারা তো বলে ব্যাট ছোঁয়াতেই পারে না!

একটু অন্যভাবে বলা যাক তাহলে, সবচেয়ে কঠিন ব্যাটসম্যান কাকে মনে হয়েছে?

হ্যাডলি: সবচেয়ে কঠিন ছিল জিওফ বয়কটকে আউট করা। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ১৫১টি সেঞ্চুরি করেছে! সে ছিল উইকেট আগলে রাখার কারিগর, টেকনিকালি নিঁখুত। একটু বাইরে বল হলেই ছেড়ে দিত, বোলারদের ক্লান্ত করে ছাড়ত। বেশ কঠিন ছিল আউট করা।

আরও অনেক কঠিন ব্যাটসম্যান ছিল। গাভাস্কার, ভিভ রিচার্ডস, গ্রেগ চ্যাপেল। ডেভিড গাওয়ার নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে অনেক রান করেছে, ব্যাটিং ছিল সৌন্দর্যময়। অ্যালান বোর্ডার ও জাভেদ মিয়াদাদ, ভয়ডরহীন, প্রতিপক্ষের জন্য বিরক্তিকর।

ব্যাটসম্যানদের মনে ভীতি ছড়ানোর কথা বলছিলেন। বোলিং দিয়ে তো অবশ্যই, পাশাপাশি মুখও কি চলত?

হ্যাডলি: আমি মাঠে কথা (স্লেজিং) বলতাম না। কিছুদিনের জন্য অবশ্য ছিল, পরে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর দ্রুতই আমার ভেতর থেকে বের হয়ে যায় এটা। সাবেক ক্রিকেটার, যারা আম্পায়ার হয়েছিল, বলেছিলেন যে এটা ক্রিকেটের চেতনার সঙ্গে যায় না। এসবের প্রয়োজন নেই, তুমি তো এর চেয়ে ভালো ক্রিকেটার ও মানুষ।

এসব না করেও আমি নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছি। গ্রেগ ম্যাথুজ দারুণভাবে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিয়েছেন, “আমার খেলা সবচেয়ে ভীতি জাগানিয়া বোলার হ্যাডলি কারণ সে মুখে কিছু বলত না।”

যদি ব্যাটসম্যানকে অফ স্টাম্পের বাইরে পরাস্ত করা যায়, ওখানে দাঁড়িয়ে চোখ টেপা, একটু মাথা ঝোঁকানো, একদৃষ্টে তাকানো। ব্যস, যথেষ্ট। ঘুরে বোলিং মার্কে গিয়ে আবার আসো। কাজেই ব্যাটসম্যান জানত যে লড়াইটা চলছেই। এটাকেই বলে কিছু না বলে ভীতি জাগানো। আমি এভাবেই খেলেছি।