নতুন করে শুরু করলে ধোনির মত হতে চাইব: হ্যারিস

টাক মাথায় এখনও তুলে রাখেন সানগ্লাস। এখনও দুর্দান্ত স্মাট। তবে জার্সির বদলে বেশিরভাগ সময়ই গায়ে এখন সুট-টাই। ৪৭ বছর বয়সেও মনে হলো বেশ ফিট। জানালেন, এখনও ক্লাব ক্রিকেট খেলছেন! ক্রিস হ্যারিস; এক সময় তাকে ছাড়া ভাবা যেত না নিউ জিল্যান্ডের ওয়ানডে দল। ক্রিকেট ছাড়ার পর ক্যারিয়ার গড়েছেন বিপণনে। তবে ধারাভাষ্য দিয়ে আছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্পর্শেও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক নিউ জিল্যান্ড অলরাউন্ডার কথা বললেন তার ক্যারিয়ার ও এখনকার জীবন নিয়ে…

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিক্রাইস্টচার্চ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2017, 12:46 PM
Updated : 17 Jan 2017, 12:49 PM

ধারাভাষ্য নিয়েই আছেন এখন?

ক্রিস হ্যারিস: সত্যি বলতে, গল্পটা ইন্টারেস্টিং। মাস তিনেক হলো ‘মিডিয়া ওয়ার্কস’ নামে একটি কোম্পানিতে যোগ দিয়েছি। নিউ জিল্যান্ড জুড়ে ওদের আটটি রেডিও স্টেশন আছে। টিভি চ্যানেল আছে, টিভি থ্রি, ব্রাভো, ভিভো। আমার ভূমিকা হলো বিপণনে। মূলত কাজ করছি রেডিও অ্যাডভার্টাজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং এসবে। দারুণ উপভোগ করছি।

এর আগে আপনি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করছিলেন বলে সম্ভবত পড়েছিলাম!

হ্যারিস: হ্যাঁ, একটি অস্ট্রেলিয়ান অর্থোপেডিক কোম্পানিতে কাজ করতাম, নাম ‘অর্থোটেক।’ তার আগে আরেকটি কোম্পানিতে কাজ করেছি যেখানে দায়িত্ব ছিল নানা গৃহস্থালী পণ্য বিপণনের। ক্রিকেটার থেকে বিপণনের লোক হয়ে গেছি। আমাদের সময় এত টি-টোয়েন্টি লিগ বা এত সুযোগ ছিল না। ক্যারিয়ার শেষে জীবিকার কথা ভাবতে হয়েছে।

মেডিকেলের কাজটা পাইয়ে দিয়েছিল আমার বন্ধু, সাবেক অস্ট্রেলিয়ান রাগবি খেলোয়াড় স্যাম স্কট-ইয়াং। আমার কাজ ছিল কোম্পানির বিভিন্ন যন্ত্র বা পণ্য সম্পর্কে সার্জনদের জানানো এবং কিনতে বলা। বেশ কিছু যন্ত্র আমদানি করা হতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রায় তিন বছর মেডিকেলের মাঠে, দারুণ উপভোগ করেছি।

যন্ত্র কেমন কাজ করছে, সমস্যা হচ্ছে কিনা, এসব দেখতে অপারেশন থিয়েটারেও থাকতে হতো আমাকে। সেটি ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। প্রতিভাবান ও দারুণ সব বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা নিপুণ হাতে কাজ করতেন, দেখতে ভালো লাগত। আমিও এর ছোট্ট অংশ, আমাদের পণ্যের মাধ্যমে মানুষের জীবন আরেকটু ভালো হচ্ছে, এটা ভেবে ভাল লাগত।

২২ গজের অভিজ্ঞতা অপারেশন থিয়েটারে কোনোভাবে সাহায্য করেছে?

হ্যারিস: কিছুটা তো বটেই। ক্রিকেট মাঠে যেমন গভীর মনোযোগ দিতে হতো, অপারেশন থিয়েটারেও তেমনই। তবে আমার ভূমিকা তো ছিল স্রেফ সতর্ক থাকা ও দেখা। আসল কাজ করতেন সার্জনরা। তাদের ব্যাপারটা ক্রিকেটের চেয়েও অনেক বড়। আরও অনেক বেশি মনোযোগী থাকতে হয় এবং সতর্কভাবে কাজ করতে হয়। কারণ মানুষের শরীরের ব্যাপার, কখনও কখনও জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার।

কিছু কিছু সার্জারি ছিল, যেমন স্পাইনালের, ১০ ঘণ্টাও লেগে যেত। সার্জনের সঙ্গে আমিও থাকতাম পুরো সময়। মাঠে মনোযোগ হারালে বড়জোর উইকেট হারাতাম বা কিছু বাজে বল হতো। থিয়েটারে মনোযোগ হারানোর সুযোগ নেই। প্রতিবারই সার্জনদের নিখুঁতভাবে শেষ কতে হয়। তাদের কাজটা সহজ করার দায়িত্ব ছিল আমার।

ক্রিকেট থেকে মেডিকেলের আঙিনায় ঢোকার সাহসটা কিভাবে পেয়েছিলেন!

হ্যারিস: আমরা যেমন ক্রিকেট পরিবার, তেমনি মেডিকেল পরিবারও! বাবা ক্রিকেট খেলেছেন (জিন হ্যারিস, নিউ জিল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৯টি টেস্ট), তবে মূলত ছিলেন ডেন্টিস্ট। দাদা, চাচা, চাচাতো ভাই-বোন, সবাই ডেন্টাল সার্জন। মেডিকেলের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাই আবহটার সঙ্গে পরিচয় ছিল। আর কাজ শুরুর করার পর দ্রুত শিখে নিয়েছি।

ক্রিকেটে ফেরা যাক। আন্তজাতিক ক্যারিয়ার শেষেও ৬-৭ বছর খেলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেট। প্রায় ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত। সেটি কি কেবল ভালোবাসার কারণে নাকি পেশার ব্যাপার ছিল?

হ্যারিস: আমি কিন্তু এখনও খেলছি! ক্রাইস্টচার্চে ক্লাব ক্রিকেট খেলি। টুকটাক কোচিং করাই। আর স্কাইয়ে মাঝেমধ্যে ধারাভাষ্য তো আছেই। পেশা যখন যেটাই থাকুক, নানা ভাবে আমি খেলাটার সঙ্গেই আছি। অবশ্যই ভালোবাসার কারণে।

ব্যাপারটা হলো আপনি উপভোগ করছেন কিনা এবং সামর্থ্য আছে কিনা। ক্যান্টারবুরির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শেষ মৌসুমেও আমার সেঞ্চুরি ছিল। তার পর ক্লাব ক্রিকেট দারুণ উপভোগ করছি। এই বয়সেও খারাপ করছি না। আমাদের দলটাও ভালো করছে। তরুণদের সঙ্গে খেলে, লড়াই করলে নিজেও ভালো থাকা যায়। ভেতরে তেজটা এখনও অনুভব করি।

এখনও কি ভূমিকা আগের মতোই-ব্যাটিং, বোলিং আর দুর্দান্ত ফিল্ডিং?

হ্যারিস: অবশ্যই, এখনও অলরাউন্ডার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আমি ছিলাম মূলত ব্যাটসম্যান যে বল করে। ৪৫ ব্যাটিং গড় খুব একটা খারাপ মনে হয় না! সঙ্গে ১৬০ উইকেট। সবসময়ই দুটো করতেই দারুণ লেগেছে। এখনও তা-ই করি।

এই ৪৭ বছর বয়সেও ফিল্ডিং নিশ্চয়ই আগের মতো ক্ষিপ্র নয়? পয়েন্ট-গালিতে নিশ্চয়ই এখন আর দাঁড়ান না!

হ্যারিস:
অবশ্যই দাঁড়াই। স্লিপেই বেশি, তবে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, গালিতেও করি ফিল্ডিং। আগের মত নই, কিন্তু এখনও যথেষ্ট ভালো। ফিল্ডিং সবসময়ই ছিল আমার প্যাশনের জায়গা। ক্লাব দলে ছেলেরা আমাকে ‘ওল্ড ম্যান’ বলে ডাকে। কিন্তু এখনও ফিল্ডিংয়ের মানটা আমি উঁচু তারে বাধার চেষ্টা করি। এখনও ডাইভ দেই, আশপাশ দিয়ে বল যেতে দেই না।

এখন টি-টোয়েন্টি আসার পর ফিল্ডিংয়ের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। আমি ঠিক করেছি, সুযোগ পেলে কোনো আইপিএল, বিপিএল, বিগ ব্যাশের দল বা যে কোনো দলের ফিল্ডিং কোচ হব।

আমাদের প্রজন্মের যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, ওই দশকটাকে আমাদের কাছে মনে হয় ক্রিকেটের জন্য দারুণ মোহনীয় এক সময়। আপনারা তখন খেলেছেন, এরকমই কি মনে হতো?

হ্যারিস: আমি দারুণ উপভোগ করেছি ওই সময়ে খেলা। টি-টোয়েন্টি তখনও আসেনি, ক্রিকেটের স্বাদটা এখানকার চেয়ে অনেক তাজা ছিল। আবহ অন্যরকম ছিল। টেস্ট ক্রিকেট আরও বেশি খেলতে পারলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু ওয়ানডে খেলেছি অনেক। সময়টা সত্যিই রোমাঞ্চকর ছিল। বিশ্বকাপগুলো ছিল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ। ১৯৯২ থেকে আস্তে আস্তে বেড়ে চলল বিশ্বকাপের জনপ্রিয়তা। বিশ্বকাপের একটা আলাদা সৌন্দর্য ও আবেদন ছিল। নব্বইয়ের দশকেই বলতে পারি, অন্তত ওয়ানডেতে আমরা অস্ট্রেলিয়ার সমান্তরালে বা অন্তত কাছাকাছি ছিলাম।

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াইটা তো শুধু ক্রিকেট বা অন্য খেলাতেই নয়, সব ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে এখানে!

হ্যারিস: বলতে পারেন। ওরা অনেকটা বড় ভাইয়ের মত, আমরা ছোট। চেষ্টা থাকে বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার। ক্রিকেটের কথা বললে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে পারা মানে আমরা জানতাম যে ভালো দল হয়ে উঠছি। সেটাই একরকম ছিল একটা মানদণ্ড। অস্ট্রেলিয়ায় বা এখানেও, লোকে বলত, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কেমন করতে পারো, সেটা দেখে বুঝব কেমন দল। এগুলো আমাদের ভেতরে খুব কাজ করত।

১৯৯২ বিশ্বকাপ… এখনও কি বুকে মোচড় দেয় সেমিফাইনালের হার?

হ্যারিস: প্রথমত বললে, ১৯৯২ বিশ্বকাপ ওই দলের সবার জন্যই স্পেশাল কিছু। কেউ কখনই ভুলবে না। আর নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটেরও টার্নিং পয়েন্ট সেটি। দেশজুড়ে যে সমর্থন আমরা পেয়েছি, ক্রিকেটের যে জোয়ার এসেছিল, সেটাই নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

মাঠের ক্রিকেটের কথা বললে, আমরা দারুণ খেলছিলাম। সব ঠিক পথেই ছিল। স্রেফ পাকিস্তানের বিপক্ষে বড় ম্যাচটায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমরা খেই হারিয়েছি। সেটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। মার্টিন ক্রো চোট পেয়ে মাঠে না থাকার কথা বলেন অনেকে। আমি সেটিকে বড় কিছু মনে করি না। ক্রো থাকলেও হতে পারত। ইনজামাম যে ইনিংস খেলেছিল, এমনিতেও যে কোনো দিন খেলতে পারত। সেদিন কিছু কিছু ব্যাপার আমরা ঠিকঠাক করতে পারিনি।

২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জয়, তখন যেটি ছিল নক আউট বিশ্বকাপ, সেটিই কি ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য?

হ্যারিস: সম্ভবত সেটিই। আমার জন্য শুধু নয়, ওই দল বা নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের জন্যও। আমাদের প্রথম আইসিসি শিরোপা, মিনি বিশ্বকাপ বলা হত। ফাইনালে ভারতের মত দলকে হারানো ছিল দারুণ। প্রাইজমানিও খুব ভালো ছিল। আমাদের মত দল, যেখানে খুব বেশি আয়ের সুযোগ নেই, খুব কাজে দিয়েছিল টাকাটা।

ফাইনালে ক্রিস কেয়ার্নসের সঙ্গে ম্যাচ জেতানো ১২২ রানের জুটির সবকিছু মনে পড়ে? লক্ষ্যের অর্ধেক পথে ৫ উইকেট হারানোর পর নিজেদের মধ্যে কি কথা হচ্ছিলো?

হ্যারিস: প্রায় সবকিছুই মনে পড়ে। আমি উইকেটে যাওয়ার পর কেয়ার্নসি বলেছিল, “সময় নাও, খেলাটা টেনে নাও।” ছোট মাঠ, আমরা জানতাম টিকে থাকলেই রান হবে। আমার পরেও অ্যাডম প্যারোরে, স্কট স্টাইরাস ছিল। কেয়ার্নসি তো যে কোনো সময় ঝড় তুলতে পারত। রান রেট নিয়ে তাই ভাবনা ছিল না। দারুণ জুটি হলো আমাদের। কিন্তু ২০ রানের মত থাকতে আউট হলাম। হতাশ হয়েছিলাম খুব। কারণ শেষ পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিলাম জয়ের মুহূর্তটায়। তবে পরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তৃপ্তিটাই বেশি ছিল।

শেষ করে আসার কাজটা তো আপনি ভালোই পারতেন। ওয়ানডেতে ৬২ বার অপরাজিত থেকেছেন, এটা কিভাবে রপ্ত করেছিলেন?

হ্যারিস: রপ্ত করতে হয়নি, করতে করতে হয়ে গেছে। আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যেটা হয়েছে, অনেকবারই টপ অর্ডার রান করতে পারেনি। মিডল বা লোয়ার মিডল অর্ডারের দায়িত্ব পড়ত দলকে টেনে নেওয়া, লড়ার মত রান এনে দেওয়া। আমিও চেষ্টা করতাম শেষ পর্যন্ত থাকতে। মোটামুটি রান রেট ধরে রেখে দলকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।

আপনার সমসাময়িক ছিলেন মাইকেল বেভান, ক্রিকেটে ‘ফিনিশার’ কথাটির জন্মই যার জন্য। পরে মহেন্দ্র সিং ধোনি সেটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এই দুজনের সঙ্গে নিজের তুলনা কিভাবে করবেন?

হ্যারিস: আমার ধরনটা বেভানের সঙ্গে মিলত। ধোনি আলাদা। আমাদের দুজনের চেয়ে ওর শট ও হাতের জোর বেশি। পাওয়ার ব্যাটিং করে। ওরা দুজনই ওয়ানডে গ্রেট। আমিও নিজের কাজটা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করেছি। হয়ত পেরেছি বলেই ক্যারিয়ার এত লম্বা করতে পেরেছি। তবে আরেকটু বিগ হিটার হতে পারলে আমার ভালো লাগত। যদি আবার নতুন করে শুরু করতে পারতাম, তাহলে আরও বিস্ফোরক হতে চাইতাম, ধোনির মত।

তার পরও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে মোটামটি তৃপ্ত। সবচেয়ে দারুণ অনুভূতি কোনটি জানেন? যখন লোকে মনে করে আমরা হেরে গেছি, সেখান থেকে দলকে লড়াইয়ে ফেরানো এবং জিতিয়ে আনা। এটির সঙ্গে তুলনীয় কিছু নেই। ক্রিকেটার হিসেবে নিজের চালিকাশক্তি আমার এটাই ছিল।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে চেন্নাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩০, ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস?

হ্যারিস: অবশ্যই। সেরা দল ও দারুণ এক বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার-ফাইনালের মত ম্যাচে। ম্যাকগ্রা, ফ্লেমিং, ওয়ার্নদের বিপক্ষে ইচ্ছেমতো খেলতে পেরেছিলাম সেদিন। এত ভালো ব্যাটিং ক্যারিয়ারে আর করেছি বলে মনে হয় না। মনে আছে, উইকেটে গিয়েছিলাম যখন, চল্লিশের মত রানে ৩ উইকেট হারিয়েছিলাম। জানতাম জিততে হলে আমাদের তিনশর কাছাকাছি করতেই হবে। সেটা আমরা পেরেছিলামও (২৮৬)। ম্যাচের প্রথম ভাগটা আমার জন্য অসাধারণ স্মৃতি। পরে তো মার্ক ওয়াহ দারুণ একটা সেঞ্চুরি করে আমাদের হারিয়ে ছিল।

আপনার বোলিং অ্যাকশন ওই যুগের সবার চোখে এখনও লেগে আছে। লেগ স্পিনারের মত করে ডেলিভারি করা, রং ফুটেড, বরাবরই অ্যাকশন ওরকম ছিল?

হ্যারিস:
শুরু করেছিলাম আসলে আরেকটু জোরে বোলার হিসেবে। ইনসুইঙ্গিং মিডিয়াম পেসার। কিন্তু সেটি খুব কার্যকর হচ্ছিলো না। এরপর চেষ্টা করলাম দ্রুতগতির লেগ স্পিন করতে। টার্ন যদিও করত না। আমাদের সময় উইকেটগুলো এখনকার মত এতটা নির্দয় উইকেট ছিল না। সব জায়গাতেই ব্যাটিং উইকেটও একটু মন্থর ছিল। আমি চিন্তা করেছিলাম যদি গতির হেরফের করাতে পারি, ব্যাটসম্যানদের ভোগানো যাবে। আমাদের দলের ফিল্ডিং ছিল দারুণ, যেটি সাহায্য করেছে।

রান আপটা বলতে পারেন ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার জন্য। অবশ্যই সবাই জানত আমার গতি কেমন বা ধরন কি। তার পরও একজন বোলার যখন লম্বা রান আপে আসে, ব্যাটসম্যানরা একটু গতিময় বলের জন্য প্রস্তুত থাকে। তখন আস্তে বল হলে খেলতে সমস্যা হয়। আমি রং ফুটেড ছিলাম, তাই মোমেন্টাম পেতাম না শেষ ভাগটায়। শেষ মুহূর্তে বলের ওপর আঙুল ঘোরাতাম, তাই আরও মন্থর হতো। স্পিনারদের গতিতেই বল করতাম। বলতে পারেন ছিলাম লম্বা রান আপের স্পিনার।

শুরুর দিকের কথা বললে, বোলিং অ্যাকশনটা ওরকম স্রেফ হয়ে গেছে। নতুন করে শুরু করলে বদলে ফেলতাম। যদি বলেন কেমন বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে লোকে, অবশ্যই সবাই বলবে শোয়েব-লির মতো ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বোলিং করা বা ওয়ার্নির মত লেগ স্পিনের জাদু দেখানো। আমার সেই উপায় ছিল না। যা ছিলাম, সেটি দিয়েই টিকে থাকার পথ খুঁজতে হয়েছে।

গ্যাভিন লারসেন ও উইলি ওয়াটসনের সঙ্গে আপনার বোলিং জুটি তো নব্বইয়ের শুরুতে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। তিনজন প্রায় একই রকম জেন্টল মিডিয়াম পেসার। ‘ডিবলি-ডবলি-উইবলি-উবলি’, নতুন বোলিং ‘টার্ম’ চালু হয়ে গেল আপনাদের নিয়ে!

হ্যারিস: গ্যাভিন ও আমার ভূমিকা ছিল একইরকম, রান আটকানো। উইলি একটু আক্রমণাত্মক। আমি দারুণ উপভোগ করেছি। কারণ দল থেকে একটা ভূমিকা দেওয়া ছিল, সেটা পালন করার সবোচ্চ চেষ্টা করতাম। ওরাও করত। তিন জনের মধ্যে তাই অলিখিত একটা লড়াই ছিল। প্রত্যেকেই চাইত অন্য দুজনের চেয়ে রান কম দিতে। তাতে লাভ হতো দলের। পরে ড্যানের (ড্যানিয়েল ভেটোরি) সঙ্গেও আমার দারুণ জুটি হয়েছিল।

যাদের বোলিং করেছেন, তাদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান কে?

হ্যারিস: একজন বলা কঠিন। ব্রায়ান লারা, শচিন টেন্ডুলকার ও অরবিন্দ ডি সিলভা, প্রথমেই মাথায় আসছে তিনটি নাম। আরও এত এত গ্রেট ছিল। রিকি পন্টিং ছিল দুর্দান্ত। মার্ক ওয়াহ, ব্যাটিং দেখলে মনে হতো এর চেয়ে সহজ কাজ আর নেই। রাজ্যের সময় ছিল ওর হাতে। স্টিভ ওয়াহ ছিল চূড়ান্ত লড়াকু।

মুখোমুখি হওয়া সেরা বোলার?

হ্যারিস: ওয়াসিম ও ওয়াকারের সেরা সময়ে তাদের খেলেছি, কাজেই সহজেই অনুমান করতে পারেন! অ্যালান ডোনাল্ড, শোয়েব আখতার… স্পিনে অবশ্যই শেন ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরন।

আপনার দেখা সেরা ফিল্ডার?

হ্যারিস: অবশ্যই জন্টি রোডস। ওর সঙ্গে নিজের অনেক মিল পেতাম। দুজনই ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়াতাম, ডাইভ দিতে পছন্দ করতাম। সবসময় মাঠে সম্পৃক্ত থাকতে পছন্দ করতাম। জন্টি হয়ত রান আউট আমার চেয়ে বেশি করেছে। এরপর রিকি পন্টিং, দুর্দান্ত অলরাউন্ড ফিল্ডার ছিল।

আপনাদের সময় যেমনটা ছিল, নাম আলাদা করে বলা যেত যে রোডস বা পন্টিং, হার্শেল গিবস, ক্রিস হ্যারিস, বিশ্বের সেরা ফিল্ডারদের মধ্যে থাকেন। এখন এভাবে নাম ধরে আলাদা করার মত ফিল্ডার খুব একটা নেই। কেন?

হ্যারিস: কারণ ফিল্ডিংয়ের সার্বিক মান আরও ভালো হয়েছে। সব দলের সব ফিল্ডারকেই এখন একটা ন্যূনতম মানে থাকতে হয়, যেটিও খুব উঁচু মানের। পার্থক্যটা তাই এখন কম। সবাই খুব ভালো। অনেক ভালোও কজন আছেন।

এই সময়ের ক্রিকেটারদের মধ্যে কাকে ভালো লাগে?

হ্যারিস: আমাদের কেন উইলিয়ামসকে অবশ্যই। যেভাবে এগোচ্ছে, নিউ জিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনাই আছে। দেখুন, সব ব্যাটসম্যানই বাজে শটে আউট হয়। কিন্তু আমি সবসময়ই ব্যাটসম্যানদের বিচার করি এটা দেখে যে কার হাতে কতটা সময় থাকে। উইলিয়ামসন অনেক সময় পায়, অনেক দেরিতে খেলে। গ্রেটনেসের সবচেয়ে বড় লক্ষণ।

ভালো লাগে বিরাট কোহলিকে। খেলাটাকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, খেলাটার প্রতি যতটা নিবেদন, তরুণদের জন্য সত্যিকারের আদর্শ।

আফসোস হয় না, আপনার সময় যদি টি-টোয়েন্টি থাকত?

হ্যারিস: টি-টোয়েন্টি খেলতে পারলে দারুণ লাগত। শেষ দিকে কিছু খেলেছি ঘরোয়া ক্রিকেটে, খারাপ করিনি। আমার ধরনটার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি খুব মানিয়ে যায়। আমি নিশ্চিত যে ভালো করতাম। হয়ত নানা লিগে খেলে মিলিওনিয়ার হয়ে যেতাম!

ঢাকায় আপনার ছোট্ট কিন্তু দুর্দান্ত একটি ইনিংস আছে। মনে পড়ে?

হারিস: অবশ্যই। কারণ সেটি আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস! ১৯৯৮ নক আউট বিশ্বকাপে, এতটা স্পষ্ট মনে আছে যে মনে হয় গতকালই খেলেছি। অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল সেঞ্চুরি করেছিল। ২৬০ রান তাড়ায় আমরা শুরুতে উইকেট হারিয়েছিলাম। পরে ফ্লেমিং আর প্যারোরে দারুণ খেলল। শেষ ৩ ওভারে আমাদের ৪০ রানের মত দরকার ছিল, সেই যুগে সেটা ছিল প্রায় অসম্ভব। সেখান থেকে ম্যাচটি জেতাতে পেরেছিলাম।

রান ছিল মাত্র চল্লিশের মত (২১ বলে ৩৭*), কিন্তু ভীষণ দরকারি! মূল টুর্নামেন্টে খেলতে হলে ম্যাচটি আমাদের জিততেই হতো। আর জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেলে সেটি হতো ভয়াবহ। মনে আছে, শেষ বলে তিন দরকার ছিল। বাউন্ডারি মেরে ড্রেসিং রুমের দিকে ছুটে গিয়েছিলাম পাগলের মত। ক্যারিয়ারে খুব কম ম্যাচেই জয়ের পর অমন উল্লাস করেছি।

এবারের সফরে আসা বাংলাদেশকে কেমন দেখলেন?

হ্যারিস: উন্নতি করছে। নিউ জিল্যান্ডে এসে ভালো করা সহজ নয়। দু-একটা ম্যাচ জিততে পারলে ভালো হতো। তবে আমি বাংলাদেশের জন্য দুঃখ অনুভব করি। কারণ এত কম খেলার সুযোগ পায়। এই সময়েই দেখুন, সময়ের সঙ্গে উন্নতি করেছে। টেস্টে দুর্দান্ত খেলল। ২০০০ সাল থেকে টেস্ট খেলছে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মাত্র চারটি খেলেছে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মত দলগুলির সঙ্গে নিয়মিত না খেললে উন্নতি করা কঠিন।

নিউ জিল্যান্ড এদিক থেকে বেশ ভালো। বাংলাদেশকে নিয়মিতই আমন্ত্রণ জানায়। উন্নতিটা কোথায় আমি বলি। আগে আমরা জানতাম বাংলাদেশকে হারাব। এবারও আশা ছিল হারাবো, কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না। বাংলাদেশ না পারলেও প্রতি ম্যাচে সেই অনিশ্চয়তা বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে, যেখান থেকে যে কেউ জিততে পারত।

আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, এই দলে এখন সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার বেশ কজন আছে। যত বেশি খেলবে, তত শিখবে। বিশ্বাস করুন, আমি নিজেও বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে রোমাঞ্চিত। কারণ আমি নিশ্চিত আগামী ৫-৬ বছরে ওরা বড় দলগুলিকে নিয়মিতই চমকে দেবে।