একদিন স্বপ্নের দিন!

ভোরের সোনা রোদে মিলিয়ে গেল যেন প্রকৃতির রুদ্ররূপ। আগের দিনের কালো মেঘ আর তীব্র বাতাস উধাও। ঝকঝকে নীলাকাশ, সাদা মেঘদলের ওড়াওড়ি আর মৃদুমন্দ বাতাসে মন ভাল করে দেওয়া সকাল। প্রভাতের সূর্যই নাকি দেয় দিনের পূর্বাভাস। কে জানত, ওয়েলিংটনের সকাল আসলে ইঙ্গিত দিচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের অদ্ভুত এক সুন্দর দিনের!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিওয়েলিংটন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2017, 02:41 AM
Updated : 13 Jan 2017, 12:35 PM

বেসিন রিজার্ভের সবুজ মখমলের বুকে দিনজুড়ে লাল কুকাবুরার ছুটোছুটি। বারবার সীমানা ছোঁয়ার বড্ড আকর্ষণ! ২২ গজে রচনা হলো নতুন ইতিহাস। রেকর্ড বইয়ের পাতা ওলটপালট। সাকিব আল হাসানের ব্যাটে অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গত করায় বারবার সেটি পেল নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নময় এক দিন।

এই মাঠে আগে চার ইনিংস খেলে বাংলাদেশ মোট রান ছিল ৫২৩। শুক্রবার দিন শেষে ৭ উইকেটে ৫৪২, ইনিংস শেষ হয়নি এখনও। ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষের স্কোরকার্ড যেন মায়াবী হাতছানি। তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে, ডুবে যেতে মন চায়, ভালো লাগার নেশা ধরিয়ে দেয়।

সাকিব-মুশফিকের ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি। একদিনে ৩৮৮ রান। বিদেশের মাটিতে এমন দিন আর কবে পেয়েছে বাংলাদেশ!

বেসিন রিজার্ভে সবশেষ তিন টেস্টেই আগে ব্যাট করেছে নিউ জিল্যান্ড। সর্বোচ্চ ব্যাট করতে পেরেছে ৫৫ ওভার, দুশ ছাড়াতে পেরেছে একবার (২২১)। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং উইকেটেও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ এই মাঠেই করল রান উৎসব!

উইকেট আগের দিনে চেয়ে একটু সহজ হয়ে গিয়েছিল বটে। তবে মোটেও তা নিষ্প্রাণ ছিল না। কিউই পেস আক্রমণ পরীক্ষাও নিয়েছে যথেষ্ট। সাকিব-মুশফিকের ব্যাটে পরীক্ষায় শুধু উতরেই যায়নি বাংলাদেশ, উল্টো নিউ জিল্যান্ডকেই ফেলে দিয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জে।

দিনের শুরুটা ছিল মুমিনুল হককে হারানো হতাশায়। আগের দিন দারুণ ব্যাট করা স্টাইলিশ বাঁহাতি এদিন আর রানই করতে পারেননি। সাত সকালের সাফল্যে নিউ জিল্যান্ড উজ্জীবিত, বাংলাদেশ একটু শঙ্কিত। সাকিব-মুশফিকের ব্যাটিংয়ে উড়ে গেল শঙ্কা, শুষে নিল কিউইদের প্রাণশক্তি।

দুজনের ব্যাটেই ছিল সেরা সময়ের ছন্দ। কিংবা দুজনেই দিনটিকে করে নিলেন সেরা দিন! বাইরের বল কাট হয়েছে, সামনের বল ড্রাইভ হয়েছে, জায়গায় পেলে দারুণ সব ফ্লিক-গ্ল্যান্স। বাউন্সারের পর বাউন্সার ডাক করেছেন দুজন। কখনও আবার চাবুকের মত নেমেছে ব্যাট।

সকালে এক স্পেলেই টানা ৩৫টি শর্ট বল করেছেন নিল ওয়াগনার। শর্ট বলের পরীক্ষায় কতবার খেই হারিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটিং! কিন্তু এই দিন ছিল নতুন অধ্যায় রচনার। দ্বিতীয় নতুন বলে বোল্ট-সাউদি আগুন ঝরিয়েছেন শুরুর কয়েক ওভার। সাকিব-মুশফিক ভুগেছেন, সামলেছেন। হাল ছাড়েননি। শত চেষ্টায় ব্যর্থ ক্লান্ত-শ্রান্ত কিউই পেসাররাই উল্টো হারিয়েছেন পথ। সাকিব-মুশফিক তুলেছেন ফায়দা।

রেকর্ড আর মাইলফলকের দিনে প্রথমটি ছিল সাকিবের একার। ৭১ রান করে বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ছুয়েঁছেন টেস্টে ৩ হাজার রান। এরপর সাকিব-মুশফিক দুজনই করেছেন টেস্ট ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় তৃপ্ত থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল এটুকুই। সাকিব-মুশফিকের মনে হয়তো ছিল নতুন বাস্তবতার সীমানা ছোঁয়ার তাড়না। রানের চাকা ঘুরল, রেকর্ডের পাতা সমৃদ্ধ হলো। বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব পেলেন ডাবল সেঞ্চুরির স্বাদ। ২৫৩ বলে দুইশ ছোঁয়াই বলে দিচ্ছিল ব্যাটের দাপট।

মুশফিকও ছিলেন একই পথে। তবে ম্যারাথন জুটির পর একটু বুঝি পেয়ে বসেছিল ক্লান্তি। ট্রেন্ট বোল্টের বাইরের বল তাড়া করে ফিরলেন ১৫৯ রানে। ভাঙল ৩৫৯ রানের মহাকাব্যিক জুটি।

যে কোনো উইকেটেই এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি। নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে সফরকারী দলের সর্বোচ্চ জুটিও।

খানিকপরই তামিম ইকবালের ২০৬ ছাড়িয়ে সাকিব উঠেলেন চূড়ায়। বাংলাদেশের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস! আগের দিন ৪ রানে আউট হতে পারতেন, ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গেছেন ১৮৯ রানেও। আরও একবার ক্যাচ হয়ে হাঁটা দিয়েছিলেন, তৃতীয় আম্পায়ার দেখেছেন বল বিজে ওয়াটলিংয়ের হাতে জমার আগে ছুঁয়েছিল ঘাস।

চ্যাম্পিয়নরা জানে সুযোগ কাজে লাগাতে। কোনো ধরনের ক্রিকেটেই কখনো এত সময় ব্যাট করেননি, খেলেননি এত বড় ইনিংস। আরও একবার দেখিয়ে দিলেন কেন তিনি স্পেশাল।

প্রথম দিনের বাংলাদেশও যেমন স্পেশাল। মুশফিক-সাকিবের আউট কিংবা দিনের শেষ বলে মিরাজের বিদায়, এসবও তাই কোনো কাঁটা নয়। দিনটি শুধুই ফুলের সৌরভের সুরভিত হওয়ার!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৩৬ ওভারে ৫৪২/৭ (তামিম ৫৬, ইমরুল ১, মুমিনুল ৬৪, মাহমুদউল্লাহ ২৬, সাকিব ২১৭, মুশফিক ১৫৯, সাব্বির ১০*, মিরাজ ০; বোল্ট ২/১২১, সাউদি ২/১৪৪, ডি গ্র্যান্ডহোম ০/৬৫, ওয়াগনার ৩/১২৪ স্যান্টনার ০/৬০, উইলিয়ামসন ০/২০)।