দুঃস্বপ্নের নিউ জিল্যান্ডে সুখস্মৃতির খোঁজে মাশরাফি

মাঠের চারপাশ জুড়ে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী বোর্ড। সেটির ওপর বসে মাশরাফি বিন মুর্তজা। অপলক চোখে তাকিয়ে সামনে; হয়ত দেখছেন ছবির মতো সুন্দর মাঠ, সবুজের এই সমুদ্র। হয়ত তাকিয়ে আরও দূরে। কিংবা কে জানে, হয়ত দেখছেন না তেমন কিছুই। ভাবছেন, আনমনে বা এক মনে!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিক্রাইস্টচার্চ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2016, 09:13 AM
Updated : 25 Dec 2016, 09:19 AM

“কি ভাবছেন?”, পরিচিত কণ্ঠ শুনেও খানিকটা যেন চমকে উঠলেন অধিনায়ক। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “ঠাণ্ডায় অবস্থা খারাপ।”

নিউ জিল্যান্ডে এখন পুরোপুরি গ্রীষ্ম। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া মাথায় রাখলে তার পরও অনেক ঠাণ্ডা। ক্রাইস্টচার্চের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে দিনের বেলা। অনভ্যস্তদের জন্য বিশেষ করে বাতাস খুবই ঠাণ্ডা; একেবারে কাঁপিয়ে দেয়।

শুধু শরীর অবশ্য নয়, মাশরাফির মনের ভেতরটিও কাঁপিয়ে দেয় নিউ জিল্যান্ড। একটি স্মৃতি, বলা ভালো দুঃসহ স্মৃতি। চোট-আঘাতে জর্জরিত ক্যারিয়ারে কোনো চোটই এখন আর আলাদা করে দুঃখ জাগায় না তেমন। নিউ জিল্যান্ডে এলে একটি স্মৃতি তবু নাড়িয়ে দেয় খানিকটা। সেই ২০০১ সালের সফর, সাইড স্ট্রেইন, ক্যারিয়ারের প্রথম ইনজুরি!

১৫ বছর আগের স্মৃতি মনে করে এখন হাসতেও পারলেন মাশরাফি।

“ইনজুরি হতে হতে এখন আর আলাদা কিছু তো ভাবি না। তবে নিউ জিল্যান্ডে এলে তো ওই ইনজুরি মনে পড়েই। ওটা দিয়েই তো শুরু…।”

হাসিমুখে বললেও কষ্টের ছোঁয়াটা টের পাওয়া যায় ঠিকই। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম নিউ জিল্যান্ড সফর। চোট-আঘাতের সঙ্গে মাশরাফির ক্যারিয়ারের অনাকাঙ্ক্ষিত বন্ধনেরও সূচনা!

সফরের মাত্র কদিন আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন মাশরাফি। গতির ঝড় তুলে আর আশার মশাল নিয়ে আবির্ভাব। কিন্তু ফাস্ট বোলারের শরীরটা তো কামানের মতো! হাত থেকে গোলা বের হলে ধাক্কাটা সহ্য করতে হয় শরীরকেও। সেই ধকল সহ্য করার মত পোক্ত ছিল না মাশরাফির আনকোরা শরীর।

হ্যামিল্টনে প্রথম টেস্টের আগে থেকেই ছিল একটু ব্যথা। এসব গ্রাহ্য করেন না এখনও, আর তখন তো বয়স ছিল ১৮। “স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি… বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি” - সেই সময়ের মাশরাফি ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার আদর্শ প্রতিচ্ছবি।

টেস্টের প্রথম দুদিন ভেসে গিয়েছি বৃষ্টিতে। তৃতীয় দিনে মাঠে নেমে মাশরাফি কাঁপিয়ে দিলেন নিউ জিল্যান্ডকে। বিদেশের মাটিতে নিজের তৃতীয় বলেই উইকেট, শিকার করলেন আগের টেস্টেই অভিষেকে সেঞ্চুরি ও অর্ধশতক করা লু ভিনসেন্টকে।

৭ ওভারের প্রথম স্পেলে ফেরালেন কিউই ব্যাটিংয়ের বড় তারকা স্টিভেন ফ্লেমিংকেও। দারুণ সেই প্রথম স্পেলটাই কাল হলো। নিজে বোলিং করছিলেন সর্বস্ব দিয়ে, অধিনায়কও বারবারই তাকে চাইছিলেন আক্রমণে।

এক পর্যায়ে শরীরের পাশে টের পেলেন বেশ ব্যথা। অধিনায়ক খালেদ মাসুদকে বললেনও সেটি। অধিনায়ক তবু বললেন সম্ভব হলে কষ্ট করে চালিয়ে নিতে। আর মাশরাফির তো এসব ব্যথায় কাবু হওয়ার নয়। আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেদিন ৬৮ ওভার করেছিল দল, মাশরাফি একাই ২৩ ওভার! সেদিন পরে নিয়েছিলেন ক্রেইগ ম্যাকমিলানের উইকেটও।

তবে গতির সঙ্গে বাড়ছিল ব্যথাও। ইনিংসে বল করেছিলেন ২৭ ওভার। এই টেস্টের তিনদিন পর বক্সিং ডে টেস্ট। ব্যথাকে জোর করে চাপা দিয়ে আবার মাঠে মাশরাফি। যা হাবার হলেঅ তা-ই। পরের টেস্টে ওয়েলিংটনে ১৬ ওভার করার পর আর করতেই পারলেন না। সাইড স্টেইন নিয়ে মাঠের বাইরে। পরের বছর (২০০২) পুরোটাই আর খেলতে পারলেন না। মাঠে ফিরতে ফিরতে ২০০৩ বিশ্বকাপ!

সেই শুরু। পরে তো বিশ্বকাপ থেকেও ফিরতে হয়েছিল ভুতুড়ে ইনজুরিতে। চলেছে ক্যারিয়ার জুড়েই।

এত দিন পরে বেদনাটা আর অতটা তীব্র নয়। তবে একটা আক্ষেপ মাশরাফির মনে উঁকি দেয় ঠিকই।

“ওই সময় যদি আরেকটু ভালোভাবে ভাবতে পারতাম, যদি নিজেকে আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, তাহলে হয়ত ক্যারিয়ারটা অন্যরকম হতে পারত। এখন আর ভেবে কী লাভ, যা হওয়ার হয়ে গেছে তখন…।”

মাশরাফিকে এক দিনে ২৩ ওভার বোলিং করানো, ব্যথা নিয়েও খেলানো, এসব কারণে তখন প্রবল সমালোচিত হয়েছিলেন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ। সমালোচনা হয়েছিল পরেও, কথা হয় এখনও। তবে সেই সময়ের বাস্তবতা ভেবে অধিনায়ককে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দেন মাশরাফি।

“হয়ত পাইলট ভাই পারতেন (অন্য ভাবে সামলাতে)… আমি যখন অধিনায়ক হয়েছি, এখন ওয়ানডেতে করছি, নিজের অভিজ্ঞতাটা মনে পড়ে। এজন্যই তাসকিন, মুস্তাফিজদের লম্বা স্পেল করাতে চাই না। তবে শুধু অধিনায়ককে দায় দিয়ে লাভ নেই। ওই সময় কারও এত বেশি ধারণা ছিল না এসব নিয়ে। ক্রিকেট আজকের মত অবস্থায় ছিল না।”

মাশরাফির মত নিউ জিল্যান্ড সফর দুঃস্বপ্ন বাংলাদেশ দলের জন্যও। ২০০১ সালের সফরের পর ২০০৭-০৮ ও ২০১০-১১ মৌসুমেও এখানে এসেছে দল। কিন্তু একটি প্রদর্শনী ম্যাচ ছাড়া কোনো বারই জিততে পারেনি কোনো ম্যাচ!

সেই নিউ জিল্যান্ডে এবার অধিনায়ক মাশরাফি। এবার সুযোগ আছে অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন ইতিহাস গড়ার। মাশরাফিও ভাবছেন ঠিক একইভাবে!

“বেশিরভাগ ম্যাচ জেতা কঠিন হবে। অন্তত কিছু ম্যাচ যদি জেতা যায়, তাহলেও দারুণ কিছু হবে। পাশের দেশ অস্ট্রেলিয়াও এখানে এসে লড়াই করে। এখানে সিরিজ জয়… অন্য দেশগুলোর জন্য যেটা স্বপ্ন, সেটা আমরা যদি শুরু করতে পারি, তাহলে অসাধারণ হবে!”

সত্যিই যদি তেমন কিছু করতে পারে দল, মাশরাফির ব্যক্তিগত কষ্টের স্মৃতিটা যেমন একটু আড়াল হবে, দেশের ক্রিকেটেরও শুরু হবে নতুন অধ্যায়। নিউ জিল্যান্ড শুধু দুঃস্বপ্ন হয়েই রইবে না, মনে বইবে সুখের প্রস্রবণও!