এ রকম উইকেটই হওয়া উচিত আমাদের ব্র্যান্ড: মাশরাফি

বাংলাদেশের অনেক স্মরণীয় জয়ের সাক্ষী মাশরাফি বিন মুর্তজা। তার হাত ধরে এসেছে অনেক জয়, কখনও ছিলেন নেতৃত্বে; বিভিন্ন সময়ে ছিলেন নানা ভূমিকায়। এবারের জয়ে ছিলেন কেবলই দর্শক। তবে এগিয়ে রাখছেন এটিকেই। ওয়ানডে অধিনায়কের মতে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের জয়ই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সাফল্য।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2016, 12:31 PM
Updated : 1 Nov 2016, 01:50 PM

মিরপুর টেস্ট জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুর রহিম বলেছিলেন, এই জয়ই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা সাফল্য। গত দুই দিনে সেটির প্রতিধ্বনি শোনা গেছে বর্তমান-সাবেক আরও অনেক ক্রিকেটারের কণ্ঠে। এবার টেস্ট অধিনায়কের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়কও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মাশরাফি বললেন, তার কাছেও এগিয়ে টেস্টের এই জয়।

“অবশ্যই আমার কাছেও সেরা জয় এটিই। গোটা ক্রিকেট বিশ্বের প্রতিক্রিয়া দেখুন, তাহলেই বোঝা যায় কেন এই জয় সেরা। একটা বড় দলের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের গুরুত্বই অন্যরকম।”

কেন এই জয় সেরা, সেটির ব্যাখ্যাও দিলেন বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো এই ক্রিকেটার। ৭ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা মাশরাফির কাছে টেস্টের সাফল্যই সব কিছুর ওপরে।

“ক্রিকেটারদের কাছে টেস্ট ম্যাচের মূল্য অন্যরকম। আজকে হয়ত টি-টোয়েন্টি দিয়ে অনেকে তারকা হয়ে যায়। কিন্তু আমি একজন ক্রিকেটারের মান বিবেচনা করব টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। খুব বেশি না হলেও আমি বেশ কিছু টেস্ট খেলেছি। টেস্ট ক্রিকেটই আমার সত্যিকার ‘টেস্ট’ নিয়েছে। একটা উইকেট পাওয়ার জন্য, একটা রান করার জন্য আমাকে সত্যিকার পরীক্ষা দিতে হয়েছে।”

“শুধু একজন ক্রিকেটার কেন, একই সঙ্গে একটা দেশের ক্রিকেটের মান কতটা উন্নত হচ্ছে, সেটির মাপকাঠিও টেস্ট ক্রিকেট। টেস্টে ভালো করছেন মানে ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে। টেস্টের সাফল্যের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না।”

স্মৃতির ভেলায় চেপে আগের কিছু স্মরণীয় সাফল্যের কথা তুলে ধরলেন মাশরাফি।

“২০০৪ সালে ভারতকে হারানো বা ২০০৫ সালে কার্ডিফ অস্ট্রেলিয়া, এরকম দারুণ কিছু জয় তো আছেই। বিশ্বকাপের সাফল্যগুলো আরও বড়। ২০০৬-০৭ সালের দিকে সত্যি বলতে কেনিয়া, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ও আমাদের তৃপ্তি দিত। সেখানে ২০০৭ বিশ্বকাপে গিয়ে ভারতকে হারিয়ে শেষ সুপার এইটে ওঠা, সেখানে র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো বড় ব্যাপার ছিল।”

“এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলা অনেক বড় সাফল্য অবশ্যই। তারপর যেটা বললাম, এগিয়ে রাখতে বললে এই টেস্ট জয়টাই সবার আগে।”

উইকেটের চ্যালেঞ্জ নিয়েই সাফল্য

মাশরাফির মতে, এই সাফল্যে বড় অবদান উইকেটের। টার্নিং উইকেটে খেলার চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিটা নিয়েছিল বলেই শেষ পর্যন্ত ধরা দিয়েছে সাফল্য।

“এ রকম উইকেটে খেলার সাহস আমরা দেখিয়েছি বলেই সাফল্য পেয়েছি। টেস্ট যুগের প্রথম কয়েক বছরে হয়ত বুঝে ওঠা কঠিন। কিন্তু অন্তত গত ৬-৭ বছরেও যদি এ রকম উইকেট আমরা বানাতাম, আজকে আমাদের টেস্ট জয় ৮টির জায়গায় ২০টি থাকত। নিষ্প্রাণ উইকেট বানিয়ে ড্রয়ের জন্য খেলে আমরা শেষ পর্যন্ত হেরেছিই।”

“আগেও যে ভালো স্পিনার ছিল না, তা কিন্তু নয়। রফিক ভাই ছিলেন। সাকিব চলে এসেছে তত দিনে। এনামুল জুনিয়র ছিল। খুব ভালো স্পিনার ছিল। কিন্তু আমাদের স্পিনারদের সেই উইকেট আমরা দিতে পারিনি।”

ওয়ানডে অধিনায়কের বিশ্বাস, এখনকার দল, টিম ম্যানেজমেন্টের বদলে যাওয়া মানসিকতার প্রতিফলনই পড়েছে উইকেটে।

“মানসিকতার পরিবর্তন অবশ্যই বড় একটি কারণ। সব দেশই নিজ দেশে খেলার সুবিধা কাজে লাগায়, আমরা পারিনি। হয়ত আগে সেই সাহসটা ছিল না। এখন ছেলেরা অনেক সাহসী, টিম ম্যানেজমেন্ট সেটাকে সাপোর্টও করে।”

বিশ্বের বেশিরভাগ টেস্ট খেলুড়ে দেশেরই উইকেটের একটা নিজস্বতা আছে। সফরকারী দলগুলি জানে, কোন মাঠে কোন ধরনের উইকেট অপেক্ষায় থাকবে। মাশরাফির মতে, এই ইংল্যান্ড সিরিজের উইকেটই হওয়া উচিত দেশের মাটিতে বাংলাদেশের আদর্শ উইকেট।

“এরকম উইকেটই হওয়া উচিত আমাদের ব্র্যান্ড। অনেক সময় ফ্ল্যাট উইকেটেও আমরা ১৫০, ২০০, ২২০ রানে অলআউট হয়েছি। প্রতিপক্ষ প্রচুর রান করে ম্যাচ জিতে নিয়েছে। জিততে হলে ২০টা উইকেট নিতে হবে। এবার দেখুন, দুটি ম্যাচই প্রায় জিতে গিয়েছিলাম। আমাদের হারানোর কিছু নেই। বরং এ রকম উইকেট থেকে পেতে পারি অনেক কিছু।”

নজর কেড়েছে ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ

সাড়া জাগিয়ে এই সিরিজে অভিষেক মেহেদী হাসান মিরাজের। সিরিজে নিয়েছেন বাংলাদেশের রেকর্ড ১৯ উইকেট। টার্নিং উইকেটে সাকিব আল হাসান, মইন আলি, আদিল রশিদের স্পিন ভুগিয়েছে ব্যাটসম্যানদের। বলা হচ্ছে এটি ছিল স্পিনারদের সিরিজ। কিন্তু মাশরাফির সবচেয়ে ভালো লেগেছে বাংলাদেশের ব্যাটিং! আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ব্যাটিংয়ের ধরন।

উইকেটে প্রথম দিন থেকেই টার্ন ও বাউন্স পেয়েছেন স্পিনাররা। ব্যাটিং ভীষণ দুরূহ ছিল বলেই এই সিরিজের একটি অর্ধশতক বা শতকের মূল্য অন্য সিরিজের চেয়ে ছিল বেশি।

তবে রান সংখ্যা নয়, মাশরাফি মুগ্ধ বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ধরনে।

“আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ। খুব ইতিবাচক ছিল ব্যাটিংয়ের ধরন। এই উইকেটে টিকে থাকা কঠিন, রান করতে হতো যতোটা দ্রুত সম্ভব। এখানে দেখুন অ্যালেস্টার কুক, জো রুটের মত ব্যাটসম্যানও সুবিধে করতে পারেনি। ওরাই যখন উইকেটে থাকতে চেয়ে পারেনি, মানে আসলেই অনেক কঠিন।”

“বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের বেশ সমালোচনাও হয়েছে। সেটির কারণও আছে কিছু কিছু। কিছু বাজে শট ছিল, বাজে সময়ে আউট হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার পরও দারুণ ব্যাপার ছিল যে আমরা উইকেট পড়তে পেরেছি। বুঝেছি যে এই উইকেটে শট খেলতে হবে। রান করতে হলে শট খেলার বিকল্প নেই। তামিম-ইমরুল তো ছিল দুর্দান্ত। বাকি সব ব্যাটসম্যানও কোনো না কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে গেছে।”

মাশরাফির বিশ্বাস, টেস্টেও বাংলাদেশের অপেক্ষায় আরও সুসময়।

“আমাদের দলটা তো মোটামুটি থিতু। ব্যাটিং লাইনআপ অভিজ্ঞ, দাঁড়িয়ে গেছে। মিরাজ এসেছে। ওর ব্যাটিংও অনেক ভালো। একটু আত্মবিশ্বাস পেলে সময়ের সঙ্গে ভালো করবে। মুস্তাফিজ ফিরবে। সব মিলিয়ে টেস্টেও আশা করি সামনে আরও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখা যাবে আমাদের।”