মাইলফলকের সামনে রোমাঞ্চিত মুশফিক

প্যাড-গ্লাভস পরে ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে কিপিং অনুশীলনে যাচ্ছিলেন মুশফিকুর রহিম। এগিয়ে গিয়ে ‘অভিনন্দন’ বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই অধিনায়ক তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। ‘হাফ সেঞ্চুরি করতে যাচ্ছেন, পঞ্চাশ টেস্ট…!’ শুনে এবার হাসলেন মুশফিক, “হ্যাঁ, মনে আছে।”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2016, 12:01 PM
Updated : 27 Oct 2016, 10:44 AM

হাসির রেশ থাকতেই অধিনায়কের পাল্টা জিজ্ঞাসা, “আমাদের আর কজন খেলেছেন পঞ্চাশ টেস্ট?” উত্তরটা জানলেন, মোহাম্মদ আশরাফুল ৬১ টেস্ট আর হাবিবুল বাশার ৫০ টেস্ট। “আমি মাত্র তৃতীয়…” স্বগতোক্তির মতো বললেন মুশফিক, “অবশ্য এটাই হওয়ার কথা, এত কম টেস্ট খেলি আমরা!”

ক্ষনিকের জন্য হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলেন অধিনায়ক। হয়ত ফিরে গেলেন অভিষেকের সময়টায়, এক লহমায় হয়ত ভেবে নিলেন গোটা ক্যারিয়ার! মুহূর্তেই আবার ফিরলেন বর্তমানে। মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চের কথা জানালেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

“৫০ টেস্ট মানে অনেক বড় ব্যাপার। অবশ্যই খুব ভালো লাগছে। বিশেষ করে আমরা তো খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগই পাই না। সেদিক থেকে ৫০ টেস্ট খেলা মানে অনেক বড় মাইলস্টোন। ভালো লাগবে এই টেস্টে যদি ভালো কিছু করতে পারি, আরও ভালো লাগবে দল ভালো কিছু করলে।”

এখনকার অধিনায়কের শুরুটা ছিল বিস্ময় জাগানিয়া। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ইংল্যান্ড সফরে জায়গা হলো ১৮ ছু্ঁইছুঁই তরুণের। সফরের প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। দ্বিতীয় ম্যাচে সাসেক্সের বিপক্ষে হোভে খেললেন ১৮ ও ৬৩ রানের ইনিংস। পরের ম্যাচে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে অপরাজিত ১১৫। সদ্য কৈশোর পেরুনো উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানকে নিয়ে পড়ে গেল হইচই।

তখনকার বাংলাদেশ দলের বাস্তবতায় টেস্ট অভিষেকটা এরপর অবধারিতই ছিল। ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে যেদিন টেস্ট ক্যাপ পেলেন মুশফিক, বয়স ১৭ বছর ৩৫১ দিন! অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই মাঠে এত কম বয়সে অভিষেক হয়নি আর কোনো ক্রিকেটারের, রেকর্ডটি টিকে আছে এখনও।

দেখলে তখন মুশফিকের বয়স মনে হতো আরও কম। ইংলিশ ধারাভাষ্যকাররা সে সময় ‘বেবিফেস’ কথাটি বলেছেন বারবার। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় এক যুগ। চেহারায় কৈশোরের ছাপ আছ এখনও। তবে পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞতা, দায়িত্বের ভার, প্রভাব, সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে হয়ে উঠেছেন বড় নাম। অভিষেকে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই খেলতে নামছেন ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্ট।  

পেছন ফিরে তাকিয়ে, শুরুর দিনগুলিতে ফিরে গিয়ে মুশফিকের মনে পড়ে, সে সময় স্বপ্ন ছিল আকাশ সমান। তবে নিশ্চিত ছিলেন না, কতটা উড়তে পারবেন এই আকাশে।

“আমার শুরু টেস্ট দিয়ে। টেস্টের প্রতি ভালোবাসাটাও ছিল আগে থেকে। সবসময়ই চাইতাম অনেক অনেক টেস্ট খেলতে। স্বপ্ন তাই অনেক ছিল। তবে শুরুতে তো আর কেউ ভাবতে পারে না এতদূর আসবে! আর আমাদের টেস্ট খেলার সুযোগই আসে কম।”

“ভালো লাগছে যে আজকে পর্যায়ে আসতে পারছি। আমাদের মাত্র দুজন ক্রিকেটার আগে পঞ্চাশ টেস্ট খেলতে পেরেছেন। নিজেকে অবশ্যই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”

এই পর্যায় আসার পথচলাটা খুব মসৃণ ছিল না। অভিষেকে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে ১৯ ও ৩ রান করে হারিয়েছিলেন জায়গা। আবার টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেন পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। নিজ শহর বগুড়ায় সেই টেস্টে ২ ও ০ করার পর আবার বাদ।

আরেকটি টেস্ট খেলার জন্য আবার অপেক্ষা ১৬ মাসের। এবার শ্রীলঙ্কা সফর। প্রথম টেস্টেও একাদশের বাইরে ছিলেন। বিবর্ণ খালেদ মাসুদের জায়গায় সুযোগ মিলল সফরের দ্বিতীয় টেস্টে। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথমবার। কলম্বোর পি সারা ওভালে সেই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের পর আর থামতে হয়নি।

মাসুদের ক্যারিয়ার থমকে গেছে ওখানেই। এগিয়েছেন মুশফিক। নানা সময়ে তার কিপিং নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন উঠেছে। অধিনায়ক হওয়ার পর ব্যাটিং-কিপিং-নেতৃত্বের ত্রিমুখী দায়িত্বের ভার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে দলে জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কখনোই আর দেননি। বরং হয়ে উঠেছেন নির্ভরতার প্রতীক। ২০০৭ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশের সবকটি টেস্ট (৪৭টি) খেলেছেন একমাত্র মুশফিকই।

মিরপুর টেস্টের পর এ বছর বাংলাদেশের আর টেস্ট নেই। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর থাকছে ১১টি টেস্ট। বাংলাদেশের হয়ে আশরাফুলের ৬১ টেস্ট খেলার রেকর্ড তাই স্পর্শ করতে পারেন আগামী বছরই। বয়স কেবলই ২৯। আশরাফুলকে ছাড়িয়েও এগিয়ে যেতে পারেন অনেক দূর।

মাঠে থাকার তৃষ্ণা আছে, ফিটনেস বরাবরই দারুণ, প্রচণ্ড পরিশ্রমী, পক্ষে বয়স। পঞ্চাশে তৃতীয় হলেও বাংলাদেশের হয়ে একশ টেস্ট খেলা প্রথম ক্রিকেটারও হতে পারেন এক সময়!

মুশফিক অবশ্য অতটা দূরে তাকাচ্ছেন না এখনই।

“টেস্ট সংখ্যা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ভাবতে হবে রান সংখ্যা। অবশ্যই চাইব দেশের হয়ে যত বেশি পারি টেস্ট খেলতে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দলে কতটা অবদান রাখতে পারছি। যত দিনই খেলি, দলে অবদান রাখতে চাই।”

মাইলফলক টেস্টে যদি তিনি রাখতে পারেন অবদান, যদি জেতে দল, সেটিই হতে পারে দেশের ক্রিকেটের জন্য, মুশফিকের নিজের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।