ঈদের আগের রাতে পায়ে অপারেশন হয়েছিল: মাশরাফি

ঈদকে ঘিরে মাশরাফি বিন মুর্তজার ভালো লাগার স্মৃতির অভাব না থাকলেও, আছে কিছু কষ্টের স্মৃতিও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বাংলাদেশ অধিনায়ক জানালেন তার ঈদ ভাবনা, খুলে দিলেন স্মৃতির দুয়ার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2016, 10:31 AM
Updated : 12 July 2016, 12:30 PM

আপনার কাছে ঈদ মানে কি?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: ঈদ-উল-ফিতর মানে তো এক মাস কষ্ট করে রোজা রাখার পুরস্কার। কষ্টের পর আনন্দ। ঈদের বৃহত্তর মূল্যবোধের কথা বললে, আমার কাছে খারাপ লাগে, সবাই আমরা ঈদে ঠিকমত আনন্দ করতে পারি না। অনেকেই নতুন কাপড় পায় না; পেলেও পার্থক্যটা বোঝা যায়। অনেকে ঠিকমত খাওয়াও পায় না। এসব খারাপ লাগে। মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের সাধ্য তো সীমিত। যতটা ইচ্ছে করে, ততটা সবসময় করা যায় না সবার জন্য।

খারাপ লাগা থেকে ভাবনা আসে না, যে কী করা উচিৎ!

মাশরাফি:
আমাদের ধর্ম ব্যপারটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আমরা যদি সবাই সাধ্যমত চারপাশের সবাইকে সাহায্য করি, অন্তত যাকাত যদি সবাই ঠিকমতো দেই, তাহলেই কিন্তু সমাজের সবাই মোটামুটি ভালো থাকতে পারি। আমার বিশ্বাস, সবাই যাকাত দিলে, মানুষের দু:খ এতটা দেখতে হবে না। ব্যবধান অনেকটা কমে যাবে। আমাদের আয়ে গরীবের হক আছে, এটা ওদের প্রাপ্য। একইভাবে সব ধর্মই কিন্তু গরীব-দু:খীকে সাহায্য করা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে। সবাই নিজের সেই দায়িত্বটুকু পালন করলেই হয়।

আপনি তো আড্ডা প্রিয়, বন্ধু প্রিয়। ঈদও কি ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটে?

মাশরাফি: আমাদের ঈদ বলতে পারেন ছিল অনেকটা ছকে বাঁধা। কী কী করব, সবার জানা। ঈদের নামাজের পর সবাই একসঙ্গে হয়ে যাওয়া, সব ধর্মের সব বন্ধু বান্ধব। ঈদ আমাদের ধর্মের হতে পারে, উৎসব তো আসলে সবার। ১০টার মধ্যে সবাই বেরিয়ে যাই।

আমাদের এক বন্ধু আছে, সবার ভাতিজা, মুদি দোকানি। ওর বাড়ি দিয়ে শুরু করতাম। সবার বাড়ি গিয়ে টুকটাক কিছু খেতাম। এরপর বাইক নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরা।

দুপুরে ধরাবাঁধা হলো আমার গ্রামের বাড়ি। আব্বা তো ওখানে ঈদ করেন। তো আব্বা আগে থেকে সব রেডি করে রাখেন। আমরা ওখানে যাই, খাই, একটু ঘুরি।

বিকেলে পুরো নড়াইল ঘোরা। সন্ধ্যার পর আড্ডা আর গান চলে। কোনো নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে ইচ্ছেমতো মজা করা।

বরাবরই এমন ছকে বাঁধা ছিল ঈদ?

মাশরাফি: এটা একটা সময়ের কথা বললাম। ঈদ তো আসলে একেক সময় একেক রকম। বয়সের সঙ্গে ঈদের অর্থও বদলায়। একটা সময় ছিল ঈদ মানেই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি। একটু সিনিয়র হলে ধরন একটু বদলেছে।

এখন ঈদে আনন্দ বলতে বউ-বাচ্চা, পরিবার-বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়েই করি। কিন্তু ২২-২৩-২৪ বছর বয়সটায় ছিল সবচেয়ে বেশি মজা।

তখন তো জাতীয় তারকা হয়ে গেছেন!

মাশরাফি: খেলি জাতীয় দলে। কিন্তু ওসব তো কখনোই মাথায় থাকে না। তখন আরও বেশি ছিল না। কোনো হিসাব-নিকাশের বালাই থাকত না। যা ইচ্ছা করতাম। এখন সবাইকে একটু হলেও সময় দিতে চাই, বলতে পারেন একটু মাপামাপির ব্যাপার আছে। তখন অফুরন্ত সময় ছিল।

বয়সের সঙ্গে বদলানোর কথা বললেন। আপনার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ঈদগুলি যদি আলাদা করে বলতে বলা হয়?

মাশরাফি: এক সময় ছিল একরকম; সকালে নামাজ পড়া। এরপর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, এদিক-সেদিক ঘোরা। নদীর পাড়ে বসতাম। খকাদার দোকান ছিল, নড়াইলে খুব জনপ্রিয়। সব প্রজন্মের সবার প্রিয় মানুষ। ওখানে যাওয়া ছিল ধরাবাঁধা। সব সময় তো খাওয়া হতো না, কিন্তু ঈদের দিন কোক-স্প্রাইট খেতেই হতো। এই তো, মজা করতে করতেই রাত ১০টা, ১১ টা বেজে যেত। এটা ছিল ক্লাস সিক্স-সেভেন পর্যন্ত।

এরপর আরেকটু বড় হলে, রিকশা-ভ্যানে ঘোরা যোগ হলো। দূরে টুরে ঘুরতে যেতাম।

আরেকটু বড় হলে, একটা জায়গায় বসে লম্বা আড্ডা দেওয়া শুরু হলো। ছোট ভাইরা আসতো। এর পর এক সময় বাইকের অভ্যাস হলো। বাইক তো খুব পছন্দ করতাম। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতাম।

উপহার দিতে বা নিতে পছন্দ করেন?

মাশরাফি: আমার কিছু কিনতে ভালো লাগে না। পেতেও খুব ভালো লাগে না। তবে দেওয়ার ব্যাপারটা শুধু ঈদ নয়, সব সময়ই দিতে পছন্দ করি। আর ঈদ তো বড় উৎসব, সবাইকে কিছু দিতে পারলে নিজের কাছে ভালো লাগে। দেওয়ার লোকের সংখ্যাও কম নয়, দিন দিন বাড়ছে। তবু চেষ্টা করি। নিজের জায়গায় মনে হয়, আমার যথেষ্ট আছে। দরকার নেই আর।

ঈদ নিয়ে কোনো স্মরণীয় ঘটনা?

মাশরাফি: একটা ছেলে ছিল আমাদের ওখানে। হাত-পায়ে সমস্যা। খুঁড়িয়ে চলত। আমি ঈদে বাড়ি গেলেই আসত। আগে থেকেই খবর রাখত। জামা-কাপড় দিতাম। ঈদের দিন সকালে আবার আসত। কিছু টাকা দিতাম। দুই ঈদ আগে বাড়ি গেলাম, ছেলেটা দুর্ঘটনায় মারা গেল। ওর মা কাজ করতে গেছে লিবিয়ায়। দাফন-টাফন আমাদেরই করতে হয়েছে। ঈদের পুরো সময়টা সেবার খুব খারাপ কেটেছে। শুধু মনে হচ্ছিলো, ঈদের আগের রাতে ছেলেটা কাপড় নিতে আসবে না! ঈদের সকালে টাকা নেবে না!

আরও কঠিন কাজ ছিল ওর মাকে জানানো। দায়িত্বটা আমারই নিতে হয়েছিল, লিবিয়ায় ওর মাকে জানানো যে আপনার ছেলেকে দাফন করে দিচ্ছি। এটা বলতে গিয়ে আমার যে কী খারাপ লেগেছে!

দেশের বাইরে ঈদ করার অভিজ্ঞতা তো হয়েছে বেশ কবার?

মাশরাফি: দেশের বাইরে ঈদ ৪-৫টা করেছি। প্রথমটির অভিজ্ঞতা খুব বাজে ছিল, সেই যে ২০০৩ বিশ্বকাপে। ঈদের আগের রাতে কানাডার কাছে হারলাম। এমনিতেও প্রথমবার দেশের বাইরে ঈদ, এরপর অমন হার।

পরে আরও কয়েকটা করতে হয়েছে। খারাপ লাগে দেশ-পরিবার থেকে দূরে ঈদ করতে। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে সয়ে গেছে।

দেশের বাইরে ঈদ নিয়ে মনে রাখার মত কোনো ঘটনা আছে?

মাশরাফি: অস্ট্রেলিয়ায় একবার পায়ে অপারেশন করালাম ঈদের আগের দিন রাতে। ২০০৪ সাল সেটি। ইচ্ছে করেই ঈদের আগের রাতটা বেছে নিয়েছিলাম। ঈদের সময় দেশের বাইরে বলে এমনিতেই খারাপ লাগতো। এজন্যই ভেবেছি জ্ঞান ফেরা-ব্যথা-কষ্ট, এসব মিলিয়ে ঈদের দিন চলে যাবে। আলাদা করে আর ঈদের কষ্ট হবে না! সেটাই হয়েছিল। ঈদ কোন দিক দিয়ে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি।

এখন তো আপনি নড়াইল গেলেই আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি লোক ভিড় করে বাড়িতে। বাড়ির বাইরে বের হলেও অনেকের অনেক বেশি আগ্রহ। নিজের মত সময় কাটাতে পারেন আগের মতো?

মাশরাফি: হ্যাঁ, এখন নিজের মতো সময় কাটানো একটু কঠিন হয়ে গেছে। বিশেষ করে গত বিশ্বকাপের পর থেকে। লোকজন আসে, কথা বলে, ছবি তুলতে চায়। অনেকে আছে অনেক দূর থেকে আসে। অনেকে হয়ত ছোটবেলায় আমাকে দেখেছে, এখন নড়াইলের বাইরে থাকে। পরিবার নিয়ে আসে দেখা করতে। ভালোবেসেই আসে সবাই। কী আর করা...সময় দিতে হয়।