চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হতে চান আল আমিন

৪৮ গড়ে ৬৭২ রান, স্ট্রাইক রেট ৮৮.০৭। রান সংগ্রহের তালিকায় চতুর্থ। বল হাতে ১৬ উইকেট। সদ্য সমাপ্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা পারফরমার আল আমিন। ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তার সতীর্থ অনেকেই খেলে ফেলেছেন জাতীয় দলে। আল আমিনের তাড়া নেই। উন্নতি করে যেতে চান। প্রস্তুত হয়েই আসতে চান জাতীয় দলে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে তার একান্ত আলাপচারিতায় ফুটে উঠলো, ২২ বছর বয়সী ক্রিকেটার এখনই দারুণ পরিণত ক্রিকেট ভাবনায়!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2016, 11:11 AM
Updated : 3 Oct 2016, 10:41 AM

ব্যাটে-বলে দারুণ একটা মৌসুম কাটল। আপনার নিজের তৃপ্তি কতটা?

আল আমিন: অবশ্যই ভালো লাগছে। ব্যাটিংয়ে চার নম্বরে আছি, উইকেটও পেয়েছি কিছু। তবে আশা আরও বেশি ছিল যে হয়তো শীর্ষে বা দুইয়ে থাকব। যেভাবে শুরু করেছিলাম, শেষটা সেভাবে করতে পারিনি।

১টি সেঞ্চুরির পাশে ৭টি হাফ সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি আর গোটা দুয়েক বেশি হলে হয়ত শীর্ষেই থাকতেন

আল আমিন: সেটাই। সেঞ্চুরি আরও ২-৩টি করা উচিত ছিল। এটা নিয়ে আমিও ভেবেছি অনেক। সত্যি বলতে প্রথম ম্যাচটি বাদ দিলে আমি সেভাবে খেলা শেষ করে আসতে পারছিলাম না। ভালো খেলতে খেলতেই আউট হয়ে গেছি। খেলা শেষ করে আসাটা জরুরি ছিল। সব ম্যাচে সেঞ্চুরি না হোক, ৫০-৬০ গুলো অন্তত ৮০-৯০ করলে ভালো হতো। দলের উপকার হতো, আমার রানও আরও বাড়ত।

ইনিংস বড় করতে না পারার কারণ কি হতে পারে? হুট করে মনোযোগ নষ্ট বা ফিটনেসে ঘাটতি?

আল আমিন: মনোযোগে ঘাটতি হতে পারে। আবার অনেক সময় ম্যাচের পরিস্থিতি একেকরকম থাকে। হয়ত শট বেশি খেলার দরকার ছিল বা লোয়ার অর্ডার চলে এসেছিল; নিজের জন্য খেলার চেয়ে দলের কথা ভাবতে হয়েছে। এ রকম সব মিলিয়েই হয়ে গেছে।

এমনিতে আপনার পারফরম্যান্স এবার যথেষ্টই ভালো। তারপরও এমন অতৃপ্তি একজন তরুণ ক্রিকেটারের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না!

আল আমিন: তরুণ ক্রিকেটার বলে নয়। আমার যেটা মনে হয়েছে, সেটা বলছি। সুপার লিগে যেমন ৫ ম্যাচে ২টি ফিফটি করেছি। এখানে অন্তত একটি সেঞ্চুরি থাকত, কিংবা ৪টি ফিফটি, তাহলে ভালো লাগত।

সিনিয়র ক্রিকেটাররা ২-৩ জন আমার চেয়ে বেশি রান করেছেন। কিন্তু জুনিয়র ক্রিকেটারদের দিকে ফোকাসটা ছিল বেশি। সেজন্যই এক নম্বরে বা দুইয়ে থাকতে পারলে আমার ভবিষ্যতের জন্য ভালো হতো।

ভবিষ্যত মানে তো নিশ্চয়ই জাতীয় দল? লিগের আগে কি এরকম লক্ষ্য ছিল যে ভালো খেলে নজরে পড়তে হবে?

আল আমিন: অবশ্যই জাতীয় দল। হ্যাঁ, টার্গেটও ছিল। এর আগে যেমন দুটি জাতীয় লিগে বেশ ভালোই খেলেছি। কিন্তু সেভাবে কেউ খেয়াল করেনি। পরে অনেকেই বলেছেন যে জাতীয় লিগের চেয়ে ঢাকা লিগে ভালো করলে ফোকাসটা বেশি পাওয়া যায়। এবার তাই সেভাবেই প্র্স্তুতি নিয়েছিলাম। প্রথম থেকেই টার্গেট ছিল সেরা হওয়া।

স্পিনের বিপক্ষে আপনার ব্যাটিং মুগ্ধতা জাগানিয়া। আপনার স্পিন খেলার রেসিপি কি?

আল আমিন: সোজা ব্যাটে ব্যাট করা। বেসিকটাই আগে মানি। সফট হ্যান্ডের ব্যাপার তো আছেই। আর গ্যাপ বের করতে জানতে হবে। বোলারকে দ্রুত পড়তে হবে। সাকিব ভাই বা রাজ (আব্দুর রাজ্জাক) ভাই কি করতে যাচ্ছেন, আমি বোঝার চেষ্টা করি। বোলারদের হাত দেখেই বোঝার চেষ্টা করি, এটা সবচেয়ে জরুরি। ফিল্ডারও পিক করতে হবে, কে ভালো, কে একটু দুর্বল। কার পাশে বল পাঠালে সিঙ্গেল নেওয়া যাবে বা সিঙ্গেলকে ডাবল করা যাবে। এসব মাথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে। ফুটওয়ার্ক তো আছেই।

বরাবরই এত ভালো খেলতেন স্পিন?

আল আমিন: ছোট থেকেই স্পিন ভালো খেলি। এখন হয়ত আরও উন্নতি হয়েছে। আরও অনেক উন্নতি করা উচিত। ঘরোয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্পিনের মানও অনেক ভালো। এখন সময় ভালো যাচ্ছে বলে ভালো করছি। খারাপ সময়ে বোঝা যাবে আসলেই আমি কতটা ভালো।

পেস বোলিং খেলায় তো আরও উন্নতি করতে হবে!

আল আমিন: ব্যাটসম্যান হিসেবে উন্নতির তো শেষ নেই। আমাদের দেশে যেটা হয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫০ ওভারের ৪০ ওভারই দেখবেন স্পিন করানো হয়। মাঝেমধ্যে আরও বেশি। লঙ্গার ভার্সনেও নতুন বলে কয়েক ওভারের পর শুধুই স্পিন। উইকেটও ব্যাটিং সহায়ক থকে, নইলে স্পিন উইকেট। ফাস্ট বোলিং খেলা শেখার সুযোগটা খুব কম হয়। যদি বাউন্সি, ঘাসের উইকেট থাকত, তখন আমাদের সেখানে খেলা শিখতে হতোই।

পেস বলে খেলায় উন্নতি করা উচিত, আমিও সেটা মনে করি। আরও কঠিন উইকেটে খেলা উচিত। আমার কমফোর্ট জোনে নয়, যেটা পারি না, সেটাই বেশি করা উচিত। কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবো, সেটাও শেখা উচিত।

শুধু পেস বোলিং খেলা নয়, চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হতে হলে সব মিলিয়েই অনেক অনেক উন্নতি করতে হবে। আমি এখন যে জায়গায় আছি, এখান থেকে আরও অন্তত ৫০ শতাংশ উন্নতি করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বোলার একদমই আস্তে বল করে, তার গতিও ৮০ মাইল। আমাদের দেশে ৮০ মাইলে বল করার বোলারই হাতে গোণা কয়েকজন। সেক্ষেত্রে সেরকম সুবিধা যদি থাকে, সামনে যদি ক্যাম্প থাকে, বিশেষ জায়গাগুলি নিয়ে কাজ করা হয়, তাহলে চেষ্টা করব এসবে উন্নতির।

চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হতে তাহলে খুব ইচ্ছে করে?

আল আমিন: অবশ্যই, খেলছিই তো নিজেকে ওই পর্যায়ে নেওয়ার জন্য। শুধু খেলার জন্য খেলে যাওয়ার মানে হয় না। ছোটবেলা থেকে ভাবনা ছিল ভালো ক্রিকেটার হওয়ার। কিন্তু এখন ভাবি চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হতে হবে। চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের চিন্তা-ভাবনাই অন্যরকম থাকে। সবার চেয়ে আলাদা। যেমন বিরাট কোহলি। যে কোনো উইকেটে, যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে মানিয়ে নিতে পারে। আমিও চিন্তা করি ব্যতিক্রমী। চাই বড় কিছু করতে।

কোহলির মতো হতে চান?

আল আমিন: তার মতোই হতে চাই না, উদাহরণ দিলাম। ছেলেবেলা থেকে ছিলাম আশরাফুল ভাইয়ের ভক্ত। দেশের বাইরে ভালো লাগে মাইকেল ক্লার্ককে।

ক্লার্কও স্পিন ভালো খেলত, এই কারণে?

আল আমিন: এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। এশিয়ায় হোক বা ইংল্যান্ডে, বা ওদের দেশে, সব জায়গায় ভালো করেছে। টেস্টে দলের প্রয়োজনের সময় বড় বড় ইনিংস আছে। ক্যাপ্টেন্সি তো ছিলই। ক্রিকেট নিয়ে কথা-ভাবনাও দারুণ। সব মিলিয়েই ভালো লাগে।

টেস্ট প্রসঙ্গে আসা হতোই। জাতীয় লিগে আপনার বড় সেঞ্চুরি আছে। ক্রিকেটের কোন সংস্করণ আপনাকে বেশি টানে?

আল আমিন: এবার হয়ত ওয়ানডে ফরম্যাটে ভালো খেলেছি। কিন্তু আমি সবসময়ই লঙ্গার ভার্সনের ভালো ব্যাটসম্যান হতে চাই। টেস্টে ভালো করতে হলে স্কিল ভালো থাকতেই হবে। চাইলেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হওয়া যায়, একটু চেষ্টা করলে ওয়ানডেও ভালো খেলা যায়। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটার হওয়া কঠিন। অনেক সাধনার ব্যাপার। ভালো টেস্ট ক্রিকেটার হতে চাই। সেটা হতে পারলে ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিও খেলতে পারব।

এই যুগের তরুণ হিসেবে এই ভাবনাও তো ব্যতিক্রম। টি-টোয়েন্টির গ্ল্যামার সবাইকে বেশি টানে!

আল আমিন: আমার সবসময়ই টেস্ট ক্রিকেট ভালো লাগত। এখনও টিভিতে টেস্ট দেখতে ভালো লাগে। ইউটিউবেও দেখি মাঝেমধ্যে। লারার ৪০০ রান দেখি, মুশফিক ভাইয়ের ২০০ দেখি। টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাপারটিই ভিন্ন। হয়ত আপনি খুব ভালো ব্যাটসম্যান বা ফর্মে আছে, তার পরও একটা সেশন খারাপ খেলতে পারেন। কিংবা প্রতিপক্ষের কোনো বোলার একটা সেশন বা স্পেলে খুব ভালো বোলিং করতে পারে। সেই সময়গুলো কিভাবে পার করে দেওয়া যায়, সারভাইভ করার পর আবার কিভাবে ডমিনেট করা যায়; এসব শেখার চেষ্টা করি। বোঝার চেষ্টা করি, লারা এভাবে খেলছে, আমি কিভাবে করতাম। এসব ভাবি।

অনুশীলন কতটা করেন?

আল আমিন: দলের অনুশীলনের বাইরেও বাড়তি অনুশীলন করি। কোনো ম্যাচে ভুল শট খেললে প্র্যাকটিসে ওটা ঠিক করার চেষ্টা করি। খেলার সময় মূলত এসব নিয়েই কাজ করি।

যে শটগুলো ভালো খেলি না, অফ সিজনে সেগুলো প্র্যাকটিস করি। সামনে যেমন স্কয়ার কাট ও পুল অনুশীলন করার ইচ্ছে আছে। আমাদের এখানে উইকেট অনেক সময়ই আনইভেন থাকে, পুল খেলার চেষ্টা করাই কঠিন। সোজা ব্যাটেই খেলতে চাই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করতে হলে পুলটা ভালো শিখতে হবেই।

অনেকে আছেন, নেটে লম্বা সময় ব্যাট করেন। অনেকে আছেন কম সময়, কিন্তু খুব ফোকাসড। আপনি কতটা সময় কাটান নেটে?

আল আমিন: আমি লম্বা সময় ব্যাট করতে পছন্দ করি। অনেকে আছে ১০-১৫ মিনিট নেটে ব্যাট করলেই ম্যাচে ভালো খেলে। আমার কাছে মনে হয়, আমার এই বয়সে মাঠে থাকার অভ্যাসটা জরুরি। নেটে দু-দেড় ঘণ্টা ব্যাটিং করলে ম্যাচেও লম্বা সময় ব্যাটিংয়ের অভ্যাসটা হয়।

আপনার অফ স্পিনটাও তো বেশ ভালো। কিন্তু বোলিং নিয়ে সেভাবে বলছেন না!

আল আমিন: বোলিং একদমই কম করা হয়। নেটেও কম করি, বড়জোর ৩-৪ ওভার। কখনোই খুব সিরিয়াস ছিলাম না বোলিং নিয়ে। তবে ম্যাচে বল হাতে নিলে জেনুইন বোলারের মতোই করি। এখন যেহেতু ভালো হচ্ছে বোলিংটা, ভালো করতে হবে।

লিগে এত ভালো করলেন, জাতীয় দলের তারকারা কেউ কিছু বলেনি?

আল আমিন: তামিম ভাই বলেছে যে স্পিনটা তুই ভালো খেলিস। ভালো সময় যাচ্ছে, কাজে লাগা। সৌরভ ভাই (মুমিনুল হক) বলেছেন যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডমিনেট করতে হলে আরও উন্নতি করতে হবে। আমার উচ্চতা ঠিক উনার মতোই। উনি সবসময় একটা কথা বলেন, অন্যরা যদি সেঞ্চুরি করে, আমাদের দেড়শ করতে হবে। অন্যরা দেড়শ করলে আমাদের দুশ। চোখ পড়ার মত করতে হলে ভালো করতে হবে।

উচ্চতাকে (৫ ফুট ৩ ইঞ্চি) বাধা মনে করেন?

আল আমিন: নাহ, একদমই না। কোচরাসহ অনেকেই বলেছেন যে আমার যে উচ্চতা, তাতে ফাস্ট বোলিং আরও ভালো খেলতে পারব। বাউন্সি উইকেটে আরও ভালো খেলতে পারবে। আমি শর্ট ফুটওয়াকে খেলি, জায়গা কম নিয়ে। এটাও একদিক থেকে ভালো। বলের জন্য অপেক্ষা করে খেলতে পারব। অস্ট্রেলিয়ায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে (২০১২ সালে) কিন্তু আমি ভালোই খেলেছিলাম। হয়ত চোখে পড়ার মত বড় রান নেই। কিন্তু কমফোর্টেবলি খেলেছি।

মৌসুম তো শেষ হলো। আপাতত পরিকল্পনা?

আল আমিন: সামনে যে সুযোগ আসবে, লুফে নিতে চাই। কোনা ক্যাম্প বা এইচপিতে ডাক আসলে, চেষ্টা করব শতভাগ ঢেলে দিয়ে যতটা সম্ভব উন্নতি করার। স্বপ্ন অবশ্যই জাতীয় দলে খেলা। তবে দূর ভবিষ্যত ভাবতে চাই না। এইচপিতে ভালো করলে হয়ত ‘এ’ টিমে ডাক আসবে। সেখানে ভালো করলে জাতীয় দল। এভাবেই ভাবছি। আমি সবসময়ই কাছের ব্যাপারটি নিয়ে ভাবি। জাতীয় দলে ডাক পেলে ভালো, না পেলেও তাড়া নেই। ভালো খেললে সুযোগ আসবেই।

সামনের কয়েক বছরে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

আল আমিন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে দেখতে চাই। জাতীয় দলে ঢুকলাম আর বের হলাম, এরকম চাই না। লম্বা সময় খেলতে চাই। জাতীয় দলে খেলতে না পারলে খারাপ লাগবে, তবে সব শেষ হয়ে যাবে না। ঘরোয়া ক্রিকেটেও এমন ভাবে খেলে যাব যেন ক্যারিয়ার শেষে লোকে অন্তত বলে যে ঘরোয়া ক্রিকেটের লেজেন্ড।