আলোর খোঁজে জুবায়ের

“এবার ফাটিয়ে দিস!” কয়েকদিন ধরে শুধু এই কথাই কানে বাজছে জুবায়ের হোসেনের। বিপিএলের অভিজ্ঞতার কারণে শঙ্কায় ছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দল পাওয়া নিয়ে। দল পেলেন, আবাহনী। তাতে জাগল আবার নতুন শঙ্কা। গত মৌসুমে এই দলে খেলেই তো লিগ কেটে গেল পানি-তোয়ালে টেনে! ড্রাফট শেষে জুবায়েরের স্বস্তি হয়ে এলো একটি ফোনকল। ভেসে এল কোচ খালেদ মাহমুদের কণ্ঠ, ‘খেলার সুযোগ পাবি, এবার ফাটিয়ে দিস!’

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 April 2016, 12:52 PM
Updated : 5 Oct 2016, 02:08 PM

প্রিমিয়ার লিগ দাঁড়িয়ে দুয়ারে। শের-ই-বাংলার ইনডোর, মিরপুর একাডেমি মাঠ ও জিম এখন সরগরম ক্রিকেটারদের পদচারণায়। কদিন আগেও চিত্র ছিল অন্যরকম, নিয়মিত দেখা মিলত হাতেগোনা কজনের। তাদের একজন জুবায়ের।

মিরপুরের একাডেমি ভবনই ঢাকায় জুবায়েরের ঘর-বাড়ি। এখানেই থাকেন। একাডেমির জিমে ফিটনেস নিয়ে কাজ, ইনডোরে আর নেটে টানা বল করে যাওয়া, দিনের পর দিন এটিই তার রুটিন। লক্ষ্য করেছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগকে। যদি একটি ভালো দল পান আর যদি মেলে খেলার সুযোগ!

ভালো দল পেয়েছেন, মিলেছে সুযোগের আশ্বাসও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আড্ডায় জুবায়েরের চোখে খুশির ঝিলিক, “সুজন ভাই বলছে এবার খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ পাব আমি, যেন ভালো করে খেলি।”

গত মৌসুমে আবাহনীতেই খেলেছিলেন। বলা ভালো, স্রেফ ‘ছিলেন।’ মৌসুম জুড়ে ছিলেন কেবলই দর্শক। খরুচে হওয়ার ভয়ে তরুণ লেগ স্পিনারকে একাদশে রাখার ঝুঁকি নিতে চাননি আবাহনীর টিম ম্যানেজমেন্ট। একটি মাত্র ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন একদম লিগের শেষ প্রান্তে। সেই ম্যাচে ৬ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে নিয়েছিলেন নাফিস ইকবাল ও সাব্বির রহমানের উইকেট। তারপর আবার বাইরে!

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ঘরোয়া ক্রিকেটে জুবায়ের একদিনের ম্যাচ খেলতে পেরেছেন ওই একটিই! তরুণ এই লেগ স্পিনারই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার, জাতীয় দল বা ‘এ’ দলের ভাবনায় তিনি সবসময়ই থাকছেন, অথচ খেলার সুযোগ পান না ঘরোয়া ক্রিকেটে!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবের পর থেকেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে গেছেন জুবায়ের। তাকে সতর্কতায় সামলানো নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। কথা হয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাকে আরও পোক্ত করে তোলার। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটেই তিনি থেকে গেছেন অপাংক্তেয়। ৬টি টেস্ট খেলেছেন, ‘এ’ দলে আরও চারটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। কিন্তু জাতীয় লিগ ও বিসিএল মিলিয়ে ২ মৌসুমে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৭টি ম্যাচ।

একদিনের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৩টি, ‘এ’ দলে তিনটি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ওই একটিই। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ক্যারিয়ারে খেলেছেন একটিই, সেটি আন্তর্জাতিক। বিপিএলে কোনো দল নেয়নি তাকে!

বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ এলেই আবার মনে পড়বে জুবায়েরকে। দীর্ঘদিন টেস্ট ম্যাচ নেই বলে দৃষ্টির আড়ালে এখন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের উপেক্ষাই তাই বেশি পুড়িয়েছে তাকে। যে কারণে দলগুলি তাকে নিতে চায় না, জুবায়ের সেটি নিয়েই কাজ করেছেন গত কয়েক মাস।

“অ্যাকুরেসি নিয়েই সবচেয়ে বেশি কাজ করছি, স্পট বোলিং করে যাচ্ছি। গুগলিসহ বৈচিত্র আমার এমনিতে খারাপ নয়। অ্যাকুরেসিটা পারফেক্ট করতে তাই চেষ্টা করছি, সঙ্গে লেগ স্পিনটা আরও ভালো করার।”

লেগ স্পিনারের নিশানা যে সবসময়ই নিখুঁত হবে না, সেটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। কবজির মোচড়ে বের হওয়া বল ফুল টস, শর্ট পিচ, হাফ ভলি পড়বে প্রায়ই। তরুণ লেগ স্পিনারের ক্ষেত্রে তো সেটি আরও বেশি। জুবায়েরও সেটা জানেন। গত এক-দেড় বছরে বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনার বলে বিবেচিত ইয়াসির শাহর সঙ্গে একটি ঘটনাও শোনালেন।  

“গত বছর পাকিস্তান যখন সফরে এসেছিল, ইয়াসির এসেছিল আমার গুগলিটা দেখতে। ওর গুগলি নাকি আমার মত এত ভালো নয়। ওর লেগ স্পিন আবার দারুণ। আমি ওর কাছ থেকে পারফেক্ট স্পটে বল ফেলা, টার্ন করানো জানতে চেয়েছিলাম।”

“সে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বয়স কত। ২০ বছর শোনার পর হেসে বলল, ‘আমার বয়স ৩০, তুমি তো আমার ছেলের সমান! ঠিক স্পটে বল ফেলা ও লেগ স্পিন এক পর্যায়ে আনতে আমার বছরের পর বছর কাজ করতে হয়েছে। লেগ স্পিন অনেক সাধনার ব্যাপার। রাতারাতি হবে না।”

সেই থেকে জুবায়ের চেষ্টায় জোর আরও বাড়িয়েছেন। লেগ স্পিন সাধনার ব্যাপার, সেটি তিনি জানেন ও মানেন। তার পরও মাঝেমধ্যে বোঝাতে পারেন না মনকে। বিশেষ করে, ঘরোয়া ক্রিকেটেও যখন হাপিত্যেশ করতে হয় সুযোগের জন্য।

এবার প্রিমিয়ার লিগকে তাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন জুবায়ের। তার চ্যালেঞ্জটা উল্টো। অন্য অনেকে হয়ত প্রিমিয়ার লিগকে করতে চাইবেন জাতীয় দলে ঢোকার সিঁড়ি। জুবায়ের চাইবেন, জাতীয় দলের সম্মান ঘরোয়া ক্রিকেটে আদায় করতে!

কোচের ভাবনা

আবাহনীর এই মৌসুমের কোচ খালেদ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করলেন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থেকেই দলে নিয়েছেন জুবায়েরকে।

“আমি মনে করি, ওর মতো একজন লেগ স্পিনার হতে পারে দলের মূল অস্ত্র। লেগ স্পিনার একটু খরুচে হবে, কিন্তু উইকেট এনে দেবে, এটা জানা কথা। আমারও ওর কাছে এটিই চাওয়া। এটা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ওকে দেওয়া হবে।”

তবে ক্লাব ক্রিকেটের একটি বাস্তবতার কথাও মনে করিয়ে দিলেন গত মৌসুমে প্রাইম ব্যাংকে শিরোপা এনে দেওয়া কোচ।

“আবাহনীর মতো ক্লাবের কাছে সমর্থকদেরও অনেক দাবি থাকে। কেউ খারাপ করলে তাকে বেশি দিন টেনে নেওয়া কঠিন, সমর্থকদের চাপ থাকে। জুবায়ের অবশ্যই পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে, তবে সেটি কাজে লাগাতেও হবে।”

আবাহনীর অনুশীলনে যে কটা দিন দেখলেন জুবায়েরকে, কোচের মনে হয়েছে আগের চেয়ে উন্নতি করেছেন তরুণ লেগ স্পিনার।

“অনুশীলনে জুবায়ের খুব ভালো বোলিং করছে, এটিই সবচেয়ে বড় কথা। উন্নতি করেছে। ম্যাচ বেশি খেলার সুযোগ পায় না বলে আত্মবিশ্বাস একটু কম আছে। কয়েকটি ম্যাচ খেললে ঠিক হয়ে যাবে।”

“শুধু একটিই সমস্যা এখন, একটু জোরে বল করছে। হয়ত সুযোগ পায় না বলে রান আটকানোর বিষয়টি ওর মাথায় কাজ করছে। কিন্তু জোরে বল করলে তো ওর বিশেষত্ব থাকবে না, ব্যাটসম্যানের জন্য খেলা সহজ হয়ে যাবে। আমরা তাই কাজ করছি যেন জুবায়ের আরেকটু আস্তে বল করে। ফ্লাইট দেয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান পা কাজে লাগায় না, ওকে খেলা কঠিন হবে। আশা করছি, সে পারবে।”

কোচের কথা মতো ‘ফাটিয়ে দিতে’, অর্থাৎ দারুণ কিছু করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী জুবায়ের। আর তার নিজের, তাকে নিয়ে আবাহনী মিশন যদি সফল হয়, সবচেয়ে বেশি লাভ বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই।