মহামূল্য মাহমুদউল্লাহ

খুব বেশি দিন হয়নি, বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে মাহমুদউল্লাহর জায়গা নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। সেই মাহমুদউল্লাহ এখন দলের ‘এমভিপি’, ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2016, 09:56 AM
Updated : 5 Oct 2016, 02:09 PM

ছক্কা-কাহন

পাকিস্তানের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর জয়সূচক বাউন্ডারি হয়ত বাংলাদেশের ক্রিকেটগাঁথার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। উইকেটে গিয়েই মাশরাফি বিন মুর্তজার দুটি বাউন্ডারিও লোকের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে অনেক দিন। লোকে শেষটাই মনে রাখে।

তবে আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। ম্যাচের সেটি ১৭তম ওভার, রান-বলের টানাপোড়েনে ম্যাচ পেণ্ডুলামের মত দুলছে- এই অবস্থা থেকে কত টি-টোয়েন্টি হেরেছে বাংলাদেশ। জমছে চাপ, বাড়ছে টেনশন। হঠাৎই একটি শট বদলে দিল আবহ। ধারাভাষ্য কক্ষে ‘প্রফেসর’ ডিন জোন্স বললেন, ‘সম্ভবত টুর্নামেন্টের সেরা শট’!

৭ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা মোহাম্মদ ইরফানের শর্ট অফ লেংথ বল, অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। চকিতে একটু জায়গা বানিয়ে সেটিকে ব্যাকফুট অফ ড্রাইভে লং অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া; পেশির শক্তি নয়, স্রেফ ব্যাটের মনোমুগ্ধকর ছোঁয়ায়। শুধু শটের ক্রিকেটীয় বিচারেই টুর্নামেন্টের সেরা শট মাহমুদউল্লাহর ওই ছক্কা। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শটের ওজন বাড়ছে আরও।

দুলতে থাকা ম্যাচ ওই শটেই বাংলাদেশের দিকে হেলে পড়া শুরু করে। তবে এই ছক্কার শট নিয়ে এত আলোচনা শুধু পাকিস্তান ম্যাচের প্রেক্ষাপটেও নয়। আগের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও একটি ছক্কা মেরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ, তার আগের ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এই প্রথম, টানা তিন ইনিংসে ছক্কা মারতে পারলেন মাহমুদউল্লাহ।

ছক্কা নিয়ে এত গুণগানের কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরেকটু পেছনে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি, শের-ই-বাংলায় অনুশীলন শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বা সিরিজ প্রসঙ্গে মাহমুদউল্লাহকে পাওয়া মানেই একটি প্রশ্ন প্রায় অবধারিত- টি-টোয়েন্টিতে তার ভূমিকা বা সামর্থ্য জাতীয় কিছু। এবার প্রশ্ন হলো। মাহমুদউল্লাহ ঝটপট বললেন, “এবার প্রতি ম্যাচে গিয়েই প্রথম বলে ছক্কা মারার চেষ্টা করব।”

মাহমুদউল্লাহর মুখে ছিল হাসি, উচ্চারণে ছিল না ঝাঁঝ। তবে কে জানে, হয়ত ওই মিষ্টি হাসি আর নরম কথাতেই লুকিয়ে ছিল ক্ষোভ, ‘কেন এত প্রশ্ন’; হয়ত লুকিয়ে ছিল প্রতিজ্ঞা, ‘এবার দেখিয়ে দেব!’

আক্ষরিক অর্থেই প্রথম বলে পারেননি, তবে সবশেষ তিন ম্যাচেই উইকেটে যাওয়ার খানিক পরই মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে এসেছে ছক্কা।

টি-টোয়েন্টি জয়

ছক্কা মারার সবশেষ এই তিন ম্যাচেই তিনি অপরাজিত। ৩৬, ২৩, ২২…ছোট্ট কিন্তু দলের জন্য অমূল্য; তিনটি ইনিংসই যে জিতিয়েছে দলকে!

টুর্নামেন্টে ৪ ইনিংসে রান ৮৮। গড়ও সেটিই ৮৮, কোনো মানদণ্ড বেঁধে না নিলেও এই গড় টুর্নামেন্টের সেরা! স্ট্রাইকরেট ১৪৬.৬৬, অন্তত ২৫ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টুর্নামেন্ট সেরা। সেরা গড়, সেরা স্ট্রাইক রেট। পাশাপাশি বল হাতে ৪টি উইকেটও। টি-টোয়েন্টির আদর্শ প্যাকেজ।

অথচ টি-টোয়েন্টিতে তার উপযোগিতা-কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ে থাকার লোকের অভাব ছিল না। কঠোর অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, শেখার ক্ষুধা ও তাড়না দিয়ে ক্যারিয়ারের আরও অনেক চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন মাহমুদউল্লাহ; জিতলেন টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের চ্যালেঞ্জও। 

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মাহমুদউল্লাহকে দেখে আসছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারের নানা ধাপ ও পর্যায়। তার টি-টোয়েন্টি সামর্থ্য নিয়ে সংশয়বাদীদের দলে কখনই ছিলেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক।

“কথাটি আমি অনেকবারই বলেছি, রিয়াদ যেখানে ব্যাট করে, কাজটি খুব কঠিন। হয়ত দ্রুত উইকেট পড়ে যায়, নয়ত দ্রুত রান করতে হয়। অনেক সময় উইকেট ধরে রাখতে হয়, দ্রুত রানও করতে হয়। বিশ্বের কত বড় বড় নাম এসব সামলাতে পারেনি। রিয়াদ বাংলাদেশের জন্য সেটি দিনের পর দিন করে আসছে।”

অতি ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি আর সাময়িক অনুভূতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে, মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারে একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে, মাশরাফির কথা কতটা সত্যি। রানসংখ্যায় হৃষ্টপুষ্ট নয় বলে আড়ালে পড়ে যায় মাহমুদউল্লাহর কতশত ইনিংস, কিন্তু ছোট্ট ওই ইনিংসগুলোই যে দলের জন্য কত মূল্যবান! কখনও দলকে জেতায়, কখনও মান বাঁচায়।

তবু প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নের বর্শার ফলা মাহমুদউল্লাহ আপন করে নিয়েছেন, সেই ফলা দিয়েই আরও শাণিত করেছেন নিজেকে। এশিয়া কাপে তাই ঝড়ো সুন্দর মাহমুদউল্লাহ। মাশরাফির মতে, ঝড় তোলার সামর্থ্যও মাহমদুউল্লাহর বরাবরই ছিল।

“দেখুন, মাহমুদউল্লাহ কিন্তু অপ্রথাগত কোনো শট খেলেনি! এমন নয় যে ব্যাটিংয়ে অনেক কিছু যোগ করেছে টি-টোয়েন্টিতে। স্রেফ ‘মাইন্ড সেট’ বদলেছে। আগে যেটা করেছে, সেটাও দলের জন্য কার্যকর ছিল। এখন হয়ত ঠিক করেছে শুরু থেকেই শট খেলবে। এখানেও সফল। ক্রিকেটার হিসেবে ওর সামর্থ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে এটিই।”

একজন ‘বিশ্বসেরা’

সামর্থ্য নিয়ে সংশয় না থাকলেও মাহমুদউল্লাহ যে নিজের খেলার নতুন দিগন্ত ক্রিকেট বিশ্বে উন্মোচিত করেছেন, এতে উচ্ছ্বসিত মাশরাফি। বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে বারবার যেভাবে উদ্ধার করছেন দলকে, একটা জায়গায় মাহমুদউল্লাহকে বিশ্ব সেরাই বললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

“রিয়াদ সে পজিশনে খেলে, সেখানে ‘সেন্সিবল’ ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন হয়। কাজটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভীষণ কঠিন। রিয়াদ ঠিকই পরিস্থিতির বিচারে পারফেক্ট ব্যাটিং করে। উইকেট ধরে রাখে, স্ট্রাইক বদলায়, একই সঙ্গে আবার ঝড়ও তোলে। যদি শুধু এই পরিস্থিতিতে ‘সেন্সিবল’ ব্যাটিংয়ের কথা বলি, শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বেই ওর মতো আর কাউকে আমি দেখি না।”

এবং দল অন্তপ্রাণ

মাশরাফির এই দলের মূল দর্শন আর সাফল্যের রেসিপি, দুটি একই। টিম স্পিরিট। দলীয় ঐক্য, পারস্পারিক সৌহার্দ্য, দলের জন্য উজার করে দেওয়া। সবোর্পরি দল অন্তপ্রাণ হওয়া। মাহমুদউল্লাহর তো এসব একদমই সহজাত, বরাবরই এই দর্শনের অনুসারী!

এমনিতে তাকে সবাই অন্তর্মুখি বলে জানলেও আপন আঙিনায় তিনি উচ্ছ্বল। ড্রেসিং রুমে প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস। মাতিয়ে রাখেন, নিজেও উপভোগ করেন। টিম মিটিংয়ে, দলের কৌশল নির্ধারণে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রয়োজনের সময় মাঠের ভেতরে-বাইরে সাকিব-তামিম-মুশফিকের মতো মাহমুদউল্লাহকেও পাশে পান মাশরাফি।

“রিয়াদ খুবই সক্রিয়। লিডারশিপ ব্যাপারটা তো ওর সহজাত, নিজেও উপভোগ করে। দারুণ সব আইডিয়া নিয়ে আসে। দলকে চাঙা রাখতেও পারে দারুণ।”

শুধু এসবে নয়, দলে নিজের ভূমিকার মত স্পর্শকাতর ব্যাপারেও কখনও উচ্চবাচ্য করেননি মাহমুদউল্লাহ। তার অভিষেক থেকে বাংলাদেশ দলে যত ক্রিকেটার এসেছেন-গিয়েছেন, তার চেয়েও বেশি বার বদলেছে হয়ত মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং পজিশন। তিন সংস্করণেই নানা সময়ে নানা পজিশনে খেলেছেন কোনো অভিযোগ-আপত্তি ছাড়াই। মাশরাফি জানালেন, সব সময় দলের চাওয়াই ছিল মাহমুদউল্লাহর চাওয়া।

“আমি তো শুরু থেকেই ওকে দেখছি। কোনোদিন দেখিনি কখনও এসব নিয়ে অভিযোগ করতে। এমনকি ‘এই পজিশনে খেলতে পারলে ভালো হতো’, মিন মিন করেও কখনও এই কথা জীবনে বলেনি। দল যেখানে খেলতে বলেছে, হাসিমুখে রাজি। সব সময় বলেছে, ‘আমি চেষ্টা করব, না পারলে আমার ব্যর্থতা’। এজন্যই দলের জন্য সে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। সবার জন্যই উদাহরণ।”

টি-টোয়েন্টিতেও ৬টি পজিশনে ব্যাট করা হয়ে গেছে তার। মাত্র গত কিছুদিন ধরে ওয়ানডে ও টেস্টে ৪ নম্বরে অনেকটা থিতু করা হয়েছে তাকে। প্রতিদানও দিয়েছেন দারুণ ধারাবাহিকতায়। টি-টোয়েন্টিতে দেওয়া হয়েছে ‘ফিনিশারের’ ভূমিকা। সাফল্য চোখের সামনেই।

ক্যারিয়ার জুড়ে চলার পথে অসংখ্য কাটাকে ফুল করে নিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। যে ফুলের সৌরভে এখন আচ্ছাদিত বাংলাদেশের ক্রিকেট। তারকা দ্যুতি তীব্র হোক বা না হোক, দলের জন্য মাহমুদউল্লাহ মহামূল্য।