অনেকের মতেই এবারের বিপিএলের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কত্ব। বরিশাল বুলসের অধিনায়ক হিসেবে মাঠের-ভেতরে বাইরে ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী, টেকনিক্যালি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ছিলেন দারুণ। অনেকেই তার মাঝে দেখছেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ অধিনায়কের ছায়া। তিনি নিজে কি ভাবছেন? বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে মাহমুদউল্লাহ শোনালেন অধিনায়কত্ব নিয়ে তার ভাবনা, দর্শন ও স্বপ্নের কথা।
Published : 06 Jan 2016, 08:03 PM
ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেকদিন থেকেই অধিনায়কত্ব করছেন। তবে এবারের বিপিএলেই সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে আপনার অধিনায়কত্ব। বাড়তি কিছু করেছিলেন?
মাহমুদউল্লাহ: আমার মনে হয় না, আলাদা কোনো ভাবনা বা স্ট্র্যাটেজি আমার ছিল। একটি ব্যাপারই ছিল মাথায় যে শেষ চারে খেলতে হবে। সেটিই ছিল প্রথম লক্ষ্য। আমরা দল ভালো ছিলাম; কিন্তু সত্যি বলতে কাগজে-কলমে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলাম। তবে সেটা ছিল সুযোগও। ভালো ক্রিকেট খেললে যে এই দল নিয়েও ভালো করা সম্ভব, সেটি দেখিয়ে দেওয়া।
তবু টুর্নামেন্ট চলার সময় বা এখন, পেছন ফিরে তাকিয়ে, নিজের কাছে কি মনে হয় যে এবার বাড়তি কিছু হয়েছে বা দেখা গেছে আপনার অধিনায়কত্বে?
বিপিএলে অনেক কিছুই অনেক সময় মাঠে পরিকল্পনামত হয়নি। তখন আমার গাট ফিলিং যা বলেছে, সেটাই করেছি; সে সবের বেশির ভাগই কাজে লেগেছে।
একটু মৌলিক প্রশ্নে যাওয়া যাক, অধিনায়কত্ব ব্যাপারটি আপনার কাছে কি?
দায়িত্ব উপভোগ করাটা দারুণ ব্যপার, কিন্তু থিওরিটিক্যালি অধিনায়কত্বকে কিভাবে দেখেন? আপনার নেতৃত্বের দর্শনটাই বা কি?
মাহমুদউল্লাহ: নেতৃত্বে আমি যেটা সব সময় অনুভব করি বা পছন্দ করি, সেটা হলো যতটা পারা যায় শান্ত ও নির্ভার থাকা। অনেক সময়ই অনেক কিছু পক্ষে আসবে না, পরিকল্পনামত হবে না, হতাশা আসবে। কিন্তু সেটা ভেতরে চেপে রেখে পরিস্থিতি জয় করার চেষ্টা করা। চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি অনেক আসবে। সেই সময় ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ধীরস্থির থেকে সেটা জয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এসব খুব খেয়াল করি এবং করার চেষ্টা করি। হতাশা বা আবেগ আমার মধ্যেও কাজ করে। কিন্তু আমি সবার আগে মনে রাখি দায়িত্বের কথা।
আরেকটা ব্যাপার হলো, আমি মনে করি অধিনায়কের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব দলের সবার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনা।
সেরাটা বের করে আনতে তো মাঠের বাইরের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মাঠের ভেতরে ও বাইরের অধিনায়কত্ব, এই ব্যাপার দুটিকে কিভাবে দেখেন?
মাঠের ভেতরে বললে, অবশ্যই ভালো একজন নেতা হতে হবে। দলের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা, যেন সবাই নিজেদের সেরাটা দিতে চায়। ক্রিকেটারদের ভেতর ওই বিশ্বাসটার জন্ম দিতে না পারলে অধিনায়কত্ব করার কোনো মানে হয় না। অনেক সময় আমরা এসব বলি শুধু বলার জন্যই। কিন্ত সত্যিকারের বিশ্বাসটা ভেতর থেকে আসে। অধিনায়ককে সেটার জন্ম দিতে হয় সতীর্থদের ভেতর। তাহলেই তারা দলের জন্য খেলে, টিম স্পিরিট দুর্দান্ত হয়।
বিপিএলের পারফরম্যান্স বলছে, অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ কাজটি ভালোই পারেন!
মাহমুদউল্লাহ: আমার জন্য নিজেকে নিয়ে বলা বিব্রতকর। আমি নিজের মতো করেই চেষ্টা করি। কতটা পারি সেটা অন্যরা বলতে পারবে।
বিপিএলে এবার আপনি অনেক আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব করেছেন। মাঠ সাজানো, বোলিং পরিবর্তন, দলের শরীরী ভাষায় সেটা ফুটে উঠেছে। আপনার অধিনায়কত্বের মূল দর্শন কি এটাই?
মাহমুদউল্লাহ: আমি সবসময়ই আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব পছন্দ করি। যতদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছি বা অধিনায়কত্ব বোঝা শুরু করেছি, তখন থেকেই। আমার মতে, আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব না করলে সাফল্য পাওয়া কঠিন। নেতৃত্বে নেতিবাচক ভাবনার সুযোগ নেই। যতটা আক্রমণাত্মক হওয়া যায়, সাফল্যের সম্ভাবনা তত বাড়ে।
বিপিএলের কথাই বলি, অনেক সময় বোলারদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আমি হয়ত ফিল্ডার বৃত্তের ভেতরে রেখেছি, বোলার চেয়েছে সীমানায় নিতে। আমি বলেছি, “নাহ, ভেতরেই থাকবে, তোমাকে সেভাবেই বোলিং করতে হবে।” ঝুঁকি থাকবে হয়ত রান দেওয়ার, কিন্ত উইকেট নেওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। আমি সেই সম্ভাবনাটা নিতে চাই। বোলার হয়ত বলেছে, “চার খেতে পারি!” আমি বলেছি, “তুই চুপ করে বোলিং কর, চার হলে আমার দায়িত্ব।” কিছু ঘটার অপেক্ষায় না থেকে আমি ঘটাতে চাই।
কিন্তু আপনার যে ভাবমূর্তি, ধরন বা কথায় কিংবা মাঠে শরীরী ভাষায় আক্রমণাত্মক ব্যাপারটি ফুটে উঠে না। অধিনায়কত্বের সময় সেটি কোথা থেকে আসে?
মাহমুদউল্লাহ: জানি না, হয়ত দায়িত্ব থেকেই চলে আসে! আমি আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই সবসময় পছন্দ করি। হয়ত বা নিজের ব্যাটিং বা খেলার ধরন দেখে মনে হতে পারে আমি রক্ষণাত্মক। কিন্তু আমার ধরন, আমার দর্শন এক নাও হতে পারে। কারণ নিজের খেলার সময় দলের অবস্থা এবং দলে নিজের ভূমিকার কথাও মাথায় রাখতে হয়।
আমরা অনেকেই জানি, ড্রেসিং রুমের আপনি অনেক হইচই, মজা করেন। 'গ্যাংনাম' নাচ সবচেয়ে ভালো পারেন আপনিই। কিন্তু ড্রেসিং রুমের বাইরে অন্তর্মুখি বলেই পরিচিতি আপনার। তবে এবারের বিপিএল জুড়েই আপনাকে দারুণ প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। ড্রেসিং রুমের বাইরেও অনেক প্রাণবন্ত ছিলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে মেশা বা সংবাদ সম্মেলনে মজা করা-এসব আলাদা করেই চোখে পড়েছে। ইচ্ছে করেই কি নিজের এই পরিবর্তন?
মাহমুদউল্লাহ: আমি যা করি, সহজাতভাবেই করি। লোক দেখানো কিছু করি না। হ্যাঁ, হয়ত খুব কম মানুষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে মিশি। মিডিয়ার সঙ্গে সেরকম সম্পর্ক হয়ত নেই বা ঘনিষ্ঠ নই। বিপিএলে যেটা হয়েছে, হয়ত অধিনায়কত্ব ভালো হয়েছে, মিডিয়ার সামনে নিয়মিত আসতে হয়েছে, সেজন্য সম্পর্ক একটু সহজ হয়েছে। এমনিতে দুষ্টুমি সব সময়ই করি। তবে এটা ঠিক, আমি কেবল ঘনিষ্ঠজনদের কাছেই খোলামেলা।
এরকম দর্শন যাদের, অধিনায়ক হিসেবে তারা কেমন?
মাহমুদউল্লাহ: মাশরাফি ভাই তো এটির উজ্জ্বল এক উদাহরণ। সবসময় টিমমেটদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে, মজা করছে। এমনকি দলের সবচেয়ে নতুন ছেলেটির সঙ্গেও করছে। আবার কাজের সময় উনি দারুণ সিরিয়াস, এই ক্ষেত্রে 'হি মিনস বিজনেস'। মাশরাফি ভাই তাই খুব ভালো উদাহরণ। মাঠের ভেতরে নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ, মাঠের বাইরে আবার তিনি সবার খুব ভালো বন্ধু বা বড় ভাই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, নির্দেশনা দেওয়া, পারস্পরিক সম্মান, এসব গুরুত্বপূর্ণ। আমিও সেভাবেই চেষ্টা করি। মাঠে ঢুকে আমি হতে চাই সত্যিকারের নেতা, মাঠের বাইরে বন্ধু।
এই প্রসঙ্গেই আসলে এগুতে চাইছিলাম। আপনার সাম্প্রতিক নেতৃত্বে অনেকেই মাশরাফির ছায়া দেখতে পাচ্ছে। আপনি বললেন, সেভাবেই চেষ্টা করছেন। এটা কি সচেতন ভাবেই করা?
মাহমুদউল্লাহ: মাশরাফি ভাই তো অবশ্যই দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক। তবে আমার প্রথম অনুপ্রেরণা সত্যি বলতে সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ)। শুরুর দিকে উনার নেতৃত্বে আমি অনেক খেলেছি, অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। সুজন ভাই কিন্তু অনেক ইমোশনাল, অনেক সিদ্ধান্তই ইমোশন থেকে নিতেন এবং সেটা সফলও হতো। ক্রিকেটের প্রতি উনার যে প্যাশন ছিল, যে ভাবনা ছিল, সেই সময় খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন কেবলই শুরু আমার, তার পরও আমি খেয়াল করতাম, আমি মনে গেঁথে রাখতাম।
দেশের বাইরের অধিনায়কদের মধ্যে, খেলা যখন শুরু করি, স্টিভ ওয়াহর অধিনায়কত্ব দারুণ লাগত। তারপর এবং এখন, মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্ব আমার ভালো লাগে। ওর স্থিরতা, শান্তভাব, এসব আমার খুব ভালো লাগে। উচ্ছ্বাস বা হতাশা, কোনোটাই মাত্রাতিরিক্ত নয়। ম্যাচের সময় দেখা যায় অনেকেই উচ্ছ্বসিত উদযাপন কছে, কিন্তু ধোনি ততটা নয়। ম্যাচ শেষে, কাজ পুরো শেষ করে তবেই উপভোগ করে। এই ব্যাপারটা আমার খুব, খুবই ভালো লাগে।
বলছিলেন যে শুরু থেকেই সুজন ভাইকে খেয়াল করতেন। তার মানে, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অধিনায়ক হওয়ার ইচ্ছেটা ছিল!
মাহমুদউল্লাহ: সত্যি বলতে, নেতা হতে ভালো লাগে আমার। সবসময়ই। অধিনায়কত্ব আমি পছন্দ করি, উপভোগ করি। সবাই নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পায় না। অনেকে অনেক বড় ক্রিকেটার হয়, কিন্তু নেতৃত্বে সফল হয় না। ব্যাপারটা উপভোগ করে না। কিন্তু আমি এই দায়িত্ব উপভোগ করি দারুণভাবে।
জাতীয় দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন, একটা পরিস্থিতির কারণে সেটা ছাড়তে হয়েছে…
মাহমুদউল্লাহ: বাজে ফর্মের কারণে… (হাসি)
যেটাই হোক, এখন ঘরোয়া ক্রিকেটে আপনার নেতৃত্ব দারুণভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতীয় দলেও ভবিষ্যত অধিনায়কের ছায়া দেখছে অনেকে। আপনি নিজে কিভাবে দেখছেন?
মাহমুদউল্লাহ: দেখুন, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে বড় সম্মান একজন ক্রিকেটারের জন্য আর হয় না। আমি মনে করি, একজন ক্রিকেটারের জীবনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যাপার এটি। কাজেই সুযোগ এলে…লোকে বলে এক পায়ে খাড়া, আমি বলব, দুই পায়েই খাড়া থাকব!
তবে এটা আপাতত বেশ দূরের বিষয়। নিজের পারফরম্যান্সেই খেয়াল রাখছি আপাতত।
দূরের বিষয় বলছেন, এখনই যদি কোনো একটি ফরম্যাটে সুযোগ আসে নেতৃত্বের?
মাহমুদউল্লাহ: এখনও প্রস্তুত আমি! যে কোনো সময় প্রস্তুত। যখনই আসুক, যেখানেই আসুক, আমি প্রস্তুত অধিনায়কত্ব করতে। বারবার যেটা বলছি, অধিনায়কত্ব দারুণ উপভোগ করি। আর নেতৃত্ব আমার নিজের সেরা খেলাটাও বের করে আনে।
বাংলাদেশের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, এটা তাহলে একদিন দেখা যেতেই পারে?
মাহমুদউল্লাহ: আপনি যেটা শুনতে চাইছেন হয়ত, সরাসরিই বলি, এটা আমার স্বপ্ন। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া আমার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণ হলে দারুণ লাগবে।