প্রতিবন্ধী ক্রিকেট: বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আইসিআরসি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের পেসার ক্যালাম ফ্লিন যখন প্রথম বলটি ছোড়ার জন্য ছোটেন, তার কানে ভেসে আসে স্বাগতিক ভক্তদের গর্জন বাংলাদেশ.. বাংলাদেশ.. বাংলাদেশ।

নুরুল ইসলাম হাসিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2015, 09:37 AM
Updated : 14 Sept 2015, 09:37 AM

অলরাউন্ডার ফ্লিন জানান, গত দেড় দশক ধরে ইংল্যান্ডে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট চললেও এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি তাদের।

প্রথমবারের মতো আয়োজিত পাঁচ জাতি টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড। ২ সেপ্টেম্বর টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা থাকলেও খেলা শুরু হয় ৪ সেপ্টেম্বর থেকে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক বাংলাদেশের কাছে হারে ইংল্যান্ড।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডকে নিয়ে হয়ে যাওয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি)।

পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জেতা ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ইয়ান নাইন টুর্নামেন্টের মিডিয়া পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন “টুর্নামেন্টে চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে।”

টুর্নামেন্টের শুরুতেই বাজে অভিজ্ঞতা হয় ইসিবির শারীরিক প্রতিবন্ধী বিভাগের প্রধান ইয়ান মার্টিনের। কোনো র‍্যাম্প না থাকায় টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা এই ক্রিকেট কর্মকর্তা।

“আতিথেয়তার দিক থেকে সবাই (খেলোয়াড়রা) খুবই সন্তুষ্ট এবং নিজেদের খুব গ্রহণযোগ্য মনে করেছে। সবাই এসে ওদের সঙ্গে ছবি তুলেছে এবং অটোগ্রাফ নিয়েছে।”

দেশে ফিরে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ডের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গত শুক্রবার বারিধারায় ব্রিটিশ হাই কমিশন অ্যামেনিটিস সেন্টার পরিদর্শন করে। এ সময় অধিনায়ক নাইন, সহ-অধিনায়ক ফ্লিন ও টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ম্যাট ব্লামায়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানান।

ইসিবির শারীরিক প্রতিবন্ধী বিভাগ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে এই টুর্নামেন্টের জন্য তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গঠনে সহায়তা করে। যুক্তরাজ্য সরকার সাভারে সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড প্রকল্পে সহায়তা করছে।

জন্মগত বিকৃতির জন্য মাত্র ১৬ মাস বয়সে অস্ত্রোপচারে পা হারানো নাইন জানান, আজ তারা যে পর্যায়ে তাতে পৌঁছাতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লেগেছে। তিনি মনে করেন, ইংল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।

ইংল্যান্ড অধিনায়কের দাদা, বাবা, চাচা, ভাইয়েরা সবাই ক্রিকেট খেলেছেন, তাই ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটা বুকে জায়গা করে নিতে বেশি সময় নেয়নি। এমনকি পা হারানোর আগেই ব্যাট হাতে নেন নাইন।

নাইনের পরিবারই ছিল তার অনুপ্রেরণা। উচ্চ প্রযুক্তির সুবিধা থাকায় নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন তিনি, “আমাদের (বাংলাদেশের চেয়ে) দুই ধাপ বেশি সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে আমাদের জনসংখ্যা কম হওয়াটা অসুবিধাও বটে।”

বিসিবির দল গঠনের জন্য হওয়া ট্যালেন্ট হান্টে শতাধিক খেলোয়াড় আসেন বলে জানান নাইন। তবে খেলার জন্য তাদের মাত্র ২৫ জনের ব্যাপারে সুপারিশ করে তারা, “এটাই পার্থক্য। আমাদের চেয়ে আপনাদের ১০ গুণ বেশি জনসংখ্যা রয়েছে।”

ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জানান, বাংলাদেশের সমর্থকরা যে ‘গর্জন’ করেছেন তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাদের, “সাত/আট মাসের মধ্যে আপনারা একটি দল পেয়েছেন যারা এই টুর্নামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়েছে। ওদের আরও ছয় মাস সময় দেওয়া হলে ওরা আরও ভালো হয়ে উঠবে।”

অধিনায়কের সঙ্গে একমত সহ-অধিনায়ক ফ্লিন, “এমনকি তিন বছর আগেও আমরা এমন একটি টুর্নামেন্টের কথা স্বপ্নেও ভাবতাম না। আমরা এতে অবাক হয়েছি। প্রতিটি ম্যাচ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি, মানসম্পন্ন ক্রিকেট খেলেছি।”

'বোন ক্যান্সার'-এর জন্য ২০০৯ সালে ডান পায়ের হাঁটু পুনর্গঠন করতে হয় ফ্লিনকে। টাইটানিয়ামের হাঁটু লাগিয়ে খেলছেন তিনি। ক্রিকেটকে ভালোবাসেন ফ্লিন, স্বপ্ন দেখেন দেশের হয়ে প্রথম শতক করার।

টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ম্যাথিউ শিল্প দুর্ঘটনায় পড়েন ২০০৯ সালে। তাই বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। তিনি জানান, তারা শারীরিক প্রতিবন্ধী দল হলেও প্রতিবন্ধকতা তাদের ভাবনাতেও আসে না।

“আমার প্রথম দুবাই সফরে আমি যখন ক্রিজে যাই সেটাই ছিল আমার সেরা ক্রিকেটীয় স্মৃতি”, চোখে জল নিয়ে বলেন ম্যাথিউ। তিনি অনুভব করেন সেই দুর্ঘটনার পর পাঁচ বছরে কোথায় পৌঁছেছেন।

“মানুষ যখন শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের কথা ভাবে তারা টেনিস বল বা কোনো নরম বলের কথা ভাবে। খুব একটা মানসম্পন্ন হবে বলে (তারা) ভাবে না। এই টুর্নামেন্ট ছিল খুবই আলাদা.. টুর্নামেন্টের খেলাগুলোর দিকে একবার শুধু তাকান।”

আইসিআরসি আগামী দিনেও এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথা ভাবছে। সেখানে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক আরও বেশি দলের অংশগ্রহণের প্রত্যাশা করছেন, “বাংলাদেশে আসাটা আমরা সবাই উপভোগ করেছি। আমরা অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড এবং ক্যারিবিয়ানেও যেতে চাইবো। আইসিসিকে এগিয়ে আনতে হবে এবং ক্রিকেটকে একত্রিত করতে হবে।”

নাইন দ্বি-পাক্ষিক সিরিজও দেখতে চান। বাংলাদেশ টেলিভিশন টুর্নামেন্টের খেলা সরাসরি সম্প্রচার করে। টিভিতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের খেলা সরাসরি দেখানোয় খুশি ইংল্যান্ডের অধিনায়ক।

“আমরা চাই, মানুষ না বলুক এটা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট। বলুক এটা খুব ভালো ক্রিকেট এবং ওরা শারীরিক প্রতিবন্ধী। আপনার প্রতিবন্ধকতা আসবে পরে।”

“আপনি যদি খেলাগুলোর হাইলাইটস দেখেন, দেখবেন এটা (শারীরিকভাবে সক্ষমদের ক্রিকেটের সঙ্গে) তুলনীয়।”