কোচ কথা না বললে টিম বয়কেই মাঠে পাঠানো যায়: মাশরাফি

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের হেরে যাওয়ার ম্যাচে বোলিং পরিবর্তন নিয়ে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর সিদ্ধান্তের পেছনে কোচের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়কের জিজ্ঞাসা, পানি পানের বিরতিতে প্রধান কোচ কি কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন অধিনায়ককে? শুধু প্রধান কোচই নয়, ফিল্ডিং কোচের ভূমিকা, দলের কৌশল, টিম ম্যানেজমেন্টের দায়সহ আরও বেশ কিছু প্রশ্ন মাশরাফি তুলেছেন তার ব্যক্তিগত ফেইসবুক পাতায় দীর্ঘ এক লেখায়।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2021, 06:56 AM
Updated : 26 Oct 2021, 01:45 PM

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গত রোববার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৭১ রানের পুঁজি নিয়েও হেরে যায় বাংলাদেশ। রান তাড়ায় এক পর্যায়ে দশম ওভারে লঙ্কানদের রান ছিল ৪ উইকেটে ৭৯। সেখান থেকে দুই অনভিজ্ঞ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান চারিথ আসালাঙ্কা ও ভানুকা রাজাপাকসার দারুণ ব্যাটিংয়ে জিতে যায় লঙ্কানরা।

এই জুটির শুরুর সময়টায় অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ যথেষ্ট চাপ তৈরি করতে পেরেছিলেন না, সেই প্রশ্ন উঠছে। সাকিব আল হাসান প্রথম স্পেলে দুর্দান্ত বোলিং করলেও দুই বাঁহাতির সামনে লম্বা সময় তাকে বোলিংয়ে আনা হয়নি। দীর্ঘসময় বোলিং থেকে দূরে রাখা হয় দলের মূল উইকেট শিকারি বোলার মুস্তাফিজুর রহমানকেও।

লঙ্কানদের ওই জুটির শুরুতে মাহমুদউল্লাহ নিজে বল করেন দুই ওভার, এক ওভার করান তিনি আফিফ হোসেনকে দিয়ে। ওই তিন ওভারে রান আসে ৩৬। চাপটা তাতে আলগা হয়ে যায়, দুই লঙ্কান ব্যাটসম্যান থিতু হয়ে যান।

অধিনায়কের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে তখন থেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে এখনও।

মাশরাফি এখানে অধিনায়কের পাশাপাশি দায় দেখছেন কোচেরও। দশম ওভারে পানি পানের বিরতি ছিল, যেটি আবার ‘স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউট’ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এই সময় কোচ ও সাপোর্ট স্টাফের সদস্যরা মাঠে গিয়ে কৌশল নিয়ে কথা বলতে পারেন। 

মাশরাফির প্রশ্ন, কোচ রাসেল ডমিঙ্গো এখানে তার কাজ ঠিকঠাক করেছেন কিনা।

“ম্যাচের ৯.৪ ওভার ৭৯ রানে ওদের ৪ উইকেট, ঠিক তখন আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী ড্রিংকস ব্রেক। তার মানে কোচ মাঠের ভিতর আসবে। আমাদের কোচও এসেছিল। তাহলে উনি এসে রিয়াদের (মাহমুদউল্লাহ) সাথে কি কথা বলেছিল? যদি বলে থাকে, তাহলে কি সব দায় রিয়াদের?”

“মানলাম, অন ফিল্ড ক্যাপ্টেন’স কল ইজ ফাইনাল। তবে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ক্রাঞ্চ মোমেন্টে কি কোচ ডিসকাশন করে না? ক্যাপ্টেন তখন বিভিন্ন বিষয়ে চাপে থাকে। তার প্ল্যান কী, এটা কি জানতে চেয়েছিল কোচ? আর যদি কথা হয়ে থাকে, তাহলে কি কোচের প্রেস হ্যান্ডেল (প্রেস কনফারেন্সে) করা উচিত ছিল না? কারণ রিয়াদের ভুলটা ধরা হয়েছে ঠিক ঐ সময় থেকেই।”

অনিয়মিত স্পিনার আফিফ হোসেনের বলেই একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ক্যাচ নিতে পারেননি লিটন দাস। মাশরাফি এখানে দেখছেন দুর্ভাগ্যের ছোঁয়া। আর সামগ্রিকভাবে অধিনায়ক ও ফিল্ডারের পাশাপাশি তিনি দায় দেখছেন কোচেরও।

“১১ নাম্বার ওভার করে মেহেদি, দলের মুল বোলার। ১২ নাম্বার ওভার করে রিয়াদ, সম্ভবত ৫/৬ রান দেয় (৫ রান)। ১৩ নাম্বার ওভার করে আফিফ, যে ওভারে ১৫ রান হয়। কিন্তু রিয়াদ যে চিন্তা থেকে আফিফকে এনেছিল, সেটাতেও কিন্তু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। যদি সুযোগ হাতছাড়া না হতো, তাহলে আমরা বলতাম দারুণ ক্যাপ্টেন্সি।”

“ক্যাচ মিসের অযুহাত না দিলেও এটাই সত্য, ক্যাচ মিস এই প্রথম হয়নি। আর লিটন দলের সেরা ফিল্ডারদের একজন। কোনো কোনো সময় ভাগ্যটাও সাথে থাকতে হয়। তাহলে স্রেফ দল সফল না হওয়ার কারণে, এই দুজনকে (মাহমুদউল্লাহ ও লিটন) এতটা তুলাধুনা করা কতটা ঠিক, আমি শিওর না। ঠিক এ কারণেই আমার মনে হয়েছে, যদি কোচ এ বিষয়ে রিয়াদের সাথে কথা না বলে থাকে, তাহলে তো ব্রেকের সময় দলের টিম বয়কেই মাঠে পাঠিয়ে দেওয়া যায় হাই-হ্যালো করতে, কোচের আর প্রয়োজন কী!”

ম্যাচের একাদশ নির্বাচন, মাঠের একটি প্রান্ত ছোট জেনেও স্পিনার বাড়ানো এবং সেই স্পিনারকে যথেষ্ট বোলিং না করানো, এসবেরও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না মাশরাফি।

“ম্যাচের আগে উইকেট অ্যাসেস শুধু ক্যাপ্টেন করে না, পুরো টিম ম্যানেজমেন্ট সাথে থাকে। তাহলে টিম করার সময় চিন্তা করেছে, উইকেট স্লো হবে, যার কারণে তাসকিনকে বসিয়ে নাসুমকে খেলানো। কিন্তু নাসুমকে পাওয়ার প্লের পর বোলিং করানো হলো না। কারণ দুজন বাহাতি ব্যাটসম্যান উইকেটে। তাহলে আগেই চিন্তা করা উচিত ছিলো, শ্রীলঙ্কার  টপ ওর্ডারে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বেশি। তার ওপর মাঠের একপাশে মাত্র ৫৬ গজ!”

“যখন নাসুমকে নেওয়া হয়েছে, তাহলে ব্রেকের সময় কোচ রিয়াদকে কি বলেছে যে, ‘নাসুম দলের মুল বোলার ওকে ব্যাক করো?’ কারণ ঐ নাসুমই ব্রেকটা পরে দিয়েছে (রাজাপাকসাকে আউট করে), ততক্ষণে ম্যাচ প্রায় শেষ। তাহলে ঐ সময় কোচ কি বসে বসে কোন প্ল্যান না করে শুধু খেলা দেখেছে? আবারও বলছি, সিদ্ধান্ত রিয়াদ নেবে। কিন্তু ওকে তো হেল্প করতে হবে! কারন মাঠে ক্যাপ্টেন কখনও কখনও অসহায় হয়ে পড়ে। আর ঠিক তখনই টিম ম্যানেজমেন্টকে টেক অফ করতে হয়। অন্যান্য দলে তো তা-ই দেখি।”

ম্যাচটি নিয়ে এত হাহুতাশ বা বিশ্লেষণও হয়তো করতে হতো না, যদি লিটন কুমার দাস সহজ দুটি ক্যাচ নিতে পারতেন। ১৪ রানে জীবন পেয়ে রাজাপাকসা করেন ৩১ বলে ৫৩। ৬৩ রানে জীবন পেয়ে আসালাঙ্কা ম্যাচ শেষ করে আসেন ৪৯ বলে ৮০ রান নিয়ে।

লিটনের ক্যাচ ছাড়ার জন্য কোনো অজুহাত দেখেন না মাশরাফি। তবে আঙুল তুলছেন তিনি ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুকের দিকে।

“লিটনের ক্যাচ মিসের কোনো এক্সকিউজ দেব না, এমনকি লিটন নিজেও দেবে না। তবে ক্যাচ মিস খেলার একটা অংশই। কিন্তু ফিল্ডিং কোচের কাছে কি এ বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাওয়া হয়? ক্যাচ মিস কি এই প্রথম হলো? ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ম্যানেজমেন্ট এর প্রায় সবাই চাকরি হারিয়েছে, স্রেফ বর্তমান ফিল্ডিং কোচ ছাড়া। তাহলে আমরা বিশ্বকাপে বা তারপর কি সেরা ফিল্ডিং সাইড হয়ে গিয়েছি?”

প্রধান কোচ ডমিঙ্গোর মতো কুকও দক্ষিণ আফ্রিকান। বাংলাদেশের দায়িত্ব পাওয়ার আগে স্রেফ একটি একাডেমির কোচ ছিলেন তিনি, উল্লেখযোগ্য কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। এছাড়া দলের ফিজিও জুলিয়ান কালেফাতোও দক্ষিণ আফ্রিকান। ডমিঙ্গো কোচ হওয়ার পর সেই সময়ের বোলিং কোচ শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান।

এই দক্ষিণ আফ্রিকান বহর নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ দেখছেন মাশরাফি। সাপোর্ট স্টাফের জন্য প্রধান কোচের যতটা দরদ, ক্রিকেটারদের জন্য তা দেখেন না তিনি।

“এখন টিম ম্যানেজমেন্ট দেখলে মনে হয় একটা রিহ্যাব সেন্টার, যেখানে সাউথ আফ্রিকার সব চাকরি না পাওয়া কোচগুলো একসাথে আমাদের রিহ্যাব সেন্টারে চাকরি করছে। এদের বাদ দেওয়া আরও বিপদ, কারণ চুক্তির পুরো টাকাটা নিয়ে চলে যাবে। তাহলে দাঁড়াল কি, তারা যতদিন থাকবে আর মন যা চাইবে, তাই করবে।”

“হেড কোচ এক-এক করে নিজ দেশের সবাইকে আনছে, এরপর যারা অস্থায়ীভাবে আছে, তাদেরও সরাবে আর নিজের মতো করে ম্যানেজমেন্ট সাজাবে। তাও মেনে নিলাম কিন্তু রাসেল (হেড কোচ) ম্যানেজমেন্টের জন্য যেভাবে স্টেপ আপ করে, মূল দলের জন্য তাহলে লুকিয়ে কেন? কেন তামিম, মুশফিক, রিয়াদ ভালো থাকে না? এটা ঠিক করা কি তার কাজ না?”

ক্রিকেটারদের দায়ও এড়িয়ে যাচ্ছেন না গত দুটি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্বে দেওয়া অধিনায়ক। তবে তার মতে, আদর্শ পরিবেশ দলকে দেওয়া হচ্ছে না।

“তারপরও দায় খেলোয়াড়দেরকেই নিতে হয়/হবে। এটাই স্বাভাবিক, কারণ মাঠে তারাই খেলে। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে, খেলোয়ারদের সেরকম পরিবেশ করে দিতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে, তাদের বিপদে কেউ পাশে না থাকুক, অন্তত টিম ম্যানেজমেন্ট থাকবে।”

“আমি আমার ক্যাপ্টেন্সির শেষ প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলাম, এই দলের কোচ যে-ই হোক না কেন, এখন এই দলের রেজাল্ট করার সময়, এক্সপেরিমেন্টের না। কোচের চাহিদা মেটানোর আগে আমাদের দেশের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। কারণ, ক্রিকেট দেশের মানুষের কাছে এখন স্রেফ খেলা নাই, রীতিমতো আবেগে পরিণত হয়েছে। ভালো করুক আমার প্রিয় দল। আল্লাহ সহায় হোন আমাদের।”