টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কড়া নাড়ছে দুয়ারে। ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সংস্করণের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আগামী রোববার পর্দা উঠবে ১৬ দলের এই প্রতিযোগিতার। পোলার্ড, ম্যাক্সওয়েল, রশিদের পাঁচ প্রিয় ক্রিকেটারের কেউ হয়তো থাকবেন নিজ দলে, কেউ প্রতিপক্ষ। কেউ হয়তো এরই মধ্যে ছেড়েছেন ক্রিকেট। তবে নিজেদের মতো করে তারা ঠিকই ছাপ রেখেছেন।
এত এত ক্রিকেটারের মধ্য থেকে পাঁচ জনকে কীভাবে বেছে নিলেন এই তিন তারকা, দিয়েছেন এর ব্যাখ্যা।
কাইরন পোলার্ড
ক্রিস গেইল: টি-টোয়েন্টির ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের একজন ক্রিস গেইল। এই সংস্করণে ব্যাটিংয়ের বেশিরভাগ রেকর্ডই তার দখলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে শুরু করে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, সব জায়গাই ক্যারিবিয়ান বাঁহাতি এই বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান রাজত্ব করেন দাপটে।
গেইলের অপরাজিত ১৭৫ রান টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২০১২ ও ২০১৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। খেলবেন এবারের আসরেও।
লাসিথ মালিঙ্গা: সীমিত ওভারের ক্রিকেটের সেরা বোলারদের একজন লাসিথ মালিঙ্গা। অদ্ভুত রাউন্ড আর্ম বোলিং অ্যাকশনের এই পেসার বিশ্বের যে কোনো ব্যাটসম্যানকে ভোগাতে পারতেন। গত সেপ্টেম্বরে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় বলা মালিঙ্গা পরিচিত ছিলেন নিখুঁত ইয়ার্কার, কার্যকর স্লোয়ারের জন্য।
দেশের হয়ে ৮৪ টি-টোয়েন্টি খেলে ২০.৭৯ গড়ে ১০৭ উইকেট নিয়েছেন মালিঙ্গা। শ্রীলঙ্কার তো বটেই, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি।
এই সংস্করণে দারুণ সব রেকর্ড আছে মালিঙ্গার। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে দুই বার হ্যাটট্রিক করার অনন্য কীর্তি আছে তার। এছাড়া চার বলে ৪ উইকেট নেওয়া দুই বোলারের একজন তিনি।
ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ২৯৫ ম্যাচে তার শিকার ৩৯০ উইকেট। এই সংস্করণে পেসারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি উইকেট আছে কেবল ডোয়াইন ব্রাভোর (৫৫০)।
মালিঙ্গার নেতৃত্বেই ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের একমাত্র শিরোপা ঘরে তোলে শ্রীলঙ্কা।
সুনিল নারাইন: একজন করে ব্যাটসম্যান ও পেসারের পর স্পিনার সুনিল নারাইনকে নিয়েছেন পোলার্ড। বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ক্রিকেটারদের একজন নারাইন।
এই সংস্করণে সব মিলিয়ে উইকেট শিকারিদের তালিকায় দুই নম্বরে আছেন তিনি। ৩৮২ ম্যাচে ওভার প্রতি ছয়ের একটু বেশি রান দিয়ে নিয়েছেন ৪২৩ উইকেট।
২০১২ সালে ক্যারিবিয়ানদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে বড় অবদান ছিল নারাইনের। ৭ ম্যাচে ওভার প্রতি কেবল ৫.৬৩ রান দিয়ে নেন ৯ উইকেট। ফাইনালে ১৩৮ রানের লক্ষ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ১০১ রানে গুটিয়ে দেওয়ার পথে মাত্র ৯ রানে ৩ উইকেট নেন এই অফ স্পিনার।
মহেন্দ্র সিং ধোনি: উইকেটের পেছনের দায়িত্বের পাশাপাশি ফিনিশারের ভূমিকার জন্য নিজের সেরা পাঁচ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে রেখেছেন পোলার্ড।
ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ফিনিশারদের একজন ধোনি এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে ৩০৬ ইনিংসে রান করেছেন ৬ হাজার ৯৩৫, গড় ৩৮.৩১ ও স্ট্রাইক রেট ১৩৪.৩৭।
কাইরন পোলার্ড: টি-টোয়েন্টিতে নিজের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকায় নিজেকেও রেখেছেন পোলার্ড। বিশ্ব সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশে নিজের জায়গা স্পষ্ট দেখেন ক্যারিবিয়ান এই অলরাউন্ডার। রশিদ খানও নিজের তালিকায় রেখেছেন পোলার্ডকে।
“এটা যদি আমার টি-টোয়েন্টির বিশ্ব একাদশ হয়, তাহলে আমিও সেখানে থাকব। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আমার রেকর্ডই আমার হয়ে কথা বলে।”
পোলার্ডের কথার যৌক্তিকতাও রয়েছে। টি-টোয়েন্টির সেরা অলরাউন্ডারদের একজন তিনি। এই সংস্করণে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ২৩৬ রান তার, ৫০৩ ইনিংসে। এই সংস্করণে ১০ হাজার রান ও ৩০০ উইকেটের ‘ডাবল’ থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি।
উইকেটে নেমেই ব্যাট হাতে ঝড় তোলার সামর্থ্য রাখেন পোলার্ড। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওভারে ছয় ছক্কার রেকর্ডও গড়েছেন তিনি। ২০ ওভারের সংস্করণে তার ১৫২.৬২ স্ট্রাইক রেট সেরা ৪০ রান সংগ্রাহকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
টি-টোয়েন্টির অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের একজন পোলার্ড। তার খেলা ৫৬৮ ম্যাচের ধারেকাছেও নেই কেউ। ৫০০ ম্যাচই খেলেছেন আর কেবল ডোয়াইন ব্রাভো, ৫০৬টি।
২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সদস্য ছিলেন পোলার্ড। পরের আসরে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। এবার ক্যারিবিয়ানদের অধিনায়ক হিসেবে নামবেন শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
রশিদ খান: অস্ট্রেলিয়ান বিস্ফোরক এই ব্যাটসম্যানের প্রথম পছন্দ রশিদ খান। জাতীয় দল কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, এই লেগ স্পিনার নিজেকে মেলে ধরেন সব জায়গায়।
টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় চতুর্থ তিনি। ২৮৪ ম্যাচ খেলে ওভার প্রতি ৬.৩৫ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩৯২ উইকেট। আফগানিস্তানের হয়ে ৫১ ম্যাচে ঝুলিতে পুরেছেন ৯৫ উইকেট, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যা পঞ্চম সর্বোচ্চ।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে চার বলে চার উইকেট নেওয়া দুই বোলারের একজন তিনি।
আন্দ্রে রাসেল: ম্যাক্সওয়েলের চোখে আন্দ্রে রাসেল যে কোনো টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বল হাতেও দারুণ কার্যকর ক্যারিবিয়ান এই অলরাউন্ডার।
টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৪০৫ রান করেছেন রাসেল ১৬৯.৬৬ স্ট্রাইক রেটে। অন্তত ২৫০ বল খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট তার। বল হাতে নিয়েছেন ৩৪০ উইকেট।
দেশের হয়ে ৬২ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ৭১৬, পেস বোলিংয়ে উইকেট নিয়েছেন ৩৬টি।
বেন স্টোকস: শেষ পর্যন্ত লড়াই করার সহজাত মানসিকতা বেন স্টোকসকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের গৌরবময় কিছু অধ্যায় তার সৌজন্যেই লেখা হয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের হলেও ম্যাক্সওয়েলের তৃতীয় পছন্দ সময়ের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন স্টোকস।
দেশের হয়ে ৩৪ টি-টোয়েন্টি খেলে ৪৪২ রানের সঙ্গে নিয়েছেন ২৮ উইকেট। যদিও পরিসংখ্যান স্টোকসের সামর্থ্য ফুটিয়ে তুলছে না খুব একটা। তবে বর্তমানে ক্রিকেট থেকে বিরতিতে থাকা এই অলরাউন্ডারের অভাব আসছে বিশ্বকাপে বেশ অনুভব করবে ইংল্যান্ড।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট: যে কোনো পরিস্থিতিতে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা কিপার-ব্যাটসম্যানদের ছোট্ট তালিকায় রাখা হয় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই ক্রিকেটারকে। ম্যাক্সওয়েলও তাই পূর্বসুরিকে রেখেছেন নিজের সেরা পাঁচে।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খুব বেশি টি-টোয়েন্টি খেলা হয়নি গিলক্রিস্টের। ১৩ ম্যাচে ১৪১.৬৬ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ২৭২ রান। সব মিলিয়ে তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার ১০২ ম্যাচের। তিন সেঞ্চুরিতে ১৪০.২৮ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ২ হাজার ৬২২ রান।
নিজের টি-টোয়েন্টি একাদশের পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হিসেবে গিলক্রিস্টকে নেওয়ার সময়ে ম্যাক্সওয়েল জানান, বিস্ফোরক এই ব্যাটসম্যানের খেলা দেখতে ভালো লাগে তার।
শন টেইট: কিছুটা অবাক করা হলেও ম্যাক্সওয়েলের সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশের প্রথম পাঁচ পছন্দের একজন শন টেইট। মূলত গতির কারণেই অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই পেসারকে দলে নিয়েছেন তিনি।
“তার বিপক্ষে খেলেছি বিধায় আমি জানি কতটা গতিময় ছিল সে। এমনকি তার ক্যারিয়ারের শেষ বেলায়ও বোলিং করত রকেটের বেগে। আমার মনে হয়, অন্য প্রান্তে থাকা যেকোনো ব্যাটসম্যানের মনে ভীতি নিশ্চিতভাবেই ছড়াবেন তিনি।”
প্রায়ই চোটে পড়া সত্ত্বেও টেইট নিয়মিতই ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করতেন। ক্যারিয়ারে ১৭১ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ডানহাতি এই পেসার, ২২.৪১ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২১৮ টি।
অস্ট্রেলিয়া হয়ে ২১ টি-টোয়েন্টিতে তার উইকেট ২৮টি।
রশিদ খান
বিরাট কোহলি: টেস্ট ও ওয়ানডের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও দারুণ ধারাবাহিক বিরাট কোহলি। এই সংস্করণে দেশের হয়ে অন্তত ২০ ইনিংস খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় ভারতীয় অধিনায়কের, ৫২.৬৫। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৩ হাজার রান করা একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনি। তার রান ৩ হাজার ১৫৯।
কোহলির বিপক্ষে অনেকবারই খেলা রশিদ দিয়েছেন ভারত অধিনায়ককে এই তালিকায় রাখার ব্যাখ্যা।
“সে (কোহলি) উইকেটের ওপর নির্ভর করে না, উইকেট যেমনই হোক না কেন, সে এমন একজন যে এগিয়ে যাবে এবং পারফর্ম করবে।”
কেন উইলিয়ামসন: গড় কিংবা স্ট্রাইক রেট আহামরি কিছু নয়। তবু রশিদের সেরা পাঁচ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের তালিকায় আছেন কেন উইলিয়ামসন। মূল কারণ, নিউ জিল্যান্ড অধিনায়কের শান্ত ও বরফ-শীতল মানসিকতা। চাপের মধ্যেও পুরো দলকে তিনি রাখতে পারেন সুস্থির। আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলার সুবাদে লম্বা সময় ধরেই উইলিয়ামসনকে বেশ কাছ থেকে দেখেছেন রশিদ।
নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে ৪৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১১টি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেছেন উইলিয়ামসন। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার অধিনায়কত্বেই সেমি-ফাইনাল খেলেছিল দলটি।
এবি ডি ভিলিয়ার্স: উদ্ভাবনী সব শটে মাঠের যে কোনো প্রান্তে বল পাঠাতে সক্ষম এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিজের সেরা পাঁচে রেখেছেন রশিদ খান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্ফোরক এই ব্যাটসম্যানকে যে কোনো দলই পেতে চাইবে বলে মনে করেন আফগান তারকা ক্রিকেটার।
“একজন ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান। সে এমন একজন, যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো উইকেটে কিংবা যে কোনো বোলারের বিপক্ষে রান এনে দিতে সক্ষম। অধিনায়ক হিসেবে, যে কেউ দলে সবসময়ই এই ব্যাটসম্যানকে পেতে চাইবেন।”
টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচ সেরার পুরস্কার ৪২ বার জিতেছেন ডি ভিলিয়ার্স। তার চেয়ে বেশি জিতেছেন কেবল ক্রিস গেইল, ৬০ বার।
হার্দিক পান্ডিয়া: বড় সংগ্রহ গড়া বা শেষ দিকে বড় রান তাড়ায় হার্দিক পান্ডিয়া ও পোলার্ডের ওপর বেশ আস্থা রশিদ খানের। তাই নিজের সেরা পাঁচে ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডারের সঙ্গে ভারতীয় অলরাউন্ডারকেও রেখেছেন তিনি।
“এই দুজনই (পোলার্ড-পান্ডিয়া) আমার মূল ব্যাটসম্যান হবে যারা শেষ চার-পাঁচ ওভারে ৮০-৯০ রান প্রয়োজন হলে তাড়া করতে পারবে। তারা এমন ব্যাটসম্যান, যারা কাজটি খুব সহজেই করতে পারে।”
বিধ্বংসী ব্যাটিং ও বল হাতে আগ্রাসন দেখাতে সক্ষম পান্ডিয়া ২০১৬ সালে অভিষেকের পর থেকেই ভারতের টি-টোয়েন্টি দলের মূল ক্রিকেটারদের একজন হয়ে উঠেছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ১৪১.৪৯ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ২ হাজার ৭২৮। পেস বোলিংয়ে ২৭.৪৫ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ১১০টি।