ব্যাটিং অর্ডারে আচমকা নিচে নামানোর পর ছন্দ হারান প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যান, এবার তিনি একাদশেরই বাইরে।
Published : 24 Oct 2023, 04:42 PM
একাদশে সাত ব্যাটসম্যান। তাদের দুজন আবার জেনুইন অলরাউন্ডার। কাজেই বিশেষজ্ঞ বোলারও আছেন একাদশে ছয় জন। সব মিলিয়ে বলা যায় খুবই ইতিবাচক ও আদর্শ একাদশ। রক্ষণাত্মক মানসিকতার প্রতিফলন অন্তত একাদশে নেই। তবু একজনের নামটি না দেখে খটকা জাগতে বাধ্য। তাওহিদ হৃদয় নেই!
হতে পারে দলীয় সমন্বয়ের বলী কিংবা ব্যাট হাতে ছন্দ হারানোর খেসারত। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের একাদশে জায়গা পাননি হৃদয়।
গত মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিলেটে ৯২ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেলে তার অভিষেক। সেই থেকে এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ২১ ওয়ানডের সবকটিতে ছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্দ অংশ। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্তও তাকে ছাড়া একাদশ ছিল অভাবনীয়। এখন সেটিই বাস্তবতা।
ম্যাচের আগের দুই দিন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে অবশ্য শুরুর দিকেই ব্যাট হাতে নেমেছিলেন হৃদয়। বেশ আগ্রাসী ব্যাট করতে দেখা গেছে তাকে। বেশ কবার বল আছড়ে ফেলছেন গ্যালারিতে। কিন্তু অনুশীলন দেখে তো আর সবসময় একাদশ গড়া হয় না। হৃদয়ের একাদশে না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় হয়তো। তবে গত কয়েক ম্যাচে তার যা পারফরম্যান্স, তাতে একাদশে না থাকাটা খুব বিস্ময়কর নয়।
প্রশ্ন হলো, ওয়ানডে ক্রিকেটে অসাধারণ শুরু করা হৃদয়ের পারফরম্যান্সে ভাটার টান কেন এলো? হুট করেই কেন তাকে মনে হচ্ছে অচেনা!
অভিষেকে ৮৫ বলে ৯২ রানের সেই ইনিংসের পর দ্বিতীয় ম্যাচে হৃদয় করেন ৩৪ বলে ৪৯। পরের সিরিজে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেই ইংল্যান্ডে খেলেন ৫৮ বলে ৬৮ রানের ইনিংস। ফিফটি করেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচেও।
এরপর এশিয়া কাপে শুরুটা ভালো না হলেও শেষ দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮২ ও ভারতের বিপক্ষে ৫৪ রানের ইনিংস খেলেন।
সব মিলিয়ে প্রথম ১৩ ইনিংসে তার ফিফটি ছিল ৫টি। ব্যাটিং গড় ছিল ৪১.৩৩, স্ট্রাইক রেট ৮৬.১১। বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য বলা যায় স্বপ্নের মতো শুরু।
শুধু পারফরম্যান্স বা পরিসংখ্যানের দিক থেকেই নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি নতুন আশার আলো হয়ে আসেন খেলার ধরন আর মানসিকতার কারণেও। নবীনের কোনো জড়তা বা অস্বস্তি তার ছিল না। ম্যাচের পর ম্যাচ একদমই সাবলিল ছিলেন। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়েছেন দারুণভাবে, সেটা বড় শট খেলে হোক বা সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে।
যদিও বড় কোনো পরীক্ষা তখনও তার হয়নি। তবে মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি হয়েই যেন এসেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের ঠিক আগে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দুই ম্যাচে তিনি ভালো করতে পারেননি। খারাপ কিছুর ইঙ্গিত তখনও ততটা মেলেনি। তবে বিশ্বকাপে আসতেই গড়বড়। হুট করেই প্রথম দুই ম্যাচে তাকে খেলানো হলো ৭ নম্বরে!
মূলত এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওপেন করে মেহেদী হাসান মিরাজের সেঞ্চুরি ও বিশ্বকাপের আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে তার ভালো ব্যাটিংয়ের পর টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনা বদলে যায়। এতদিনের সব পরিকল্পনায় বদল এনে ব্যাটিং অর্ডার বদলে ফেলা হয়। মিরাজকে নিয়মিত ওপরে জায়গা দিতে গিয়ে ব্যাটিং অর্ডারে ওলট-পালট করা হয়। হঠাৎই বদলে যায় হৃদয়ের ভূমিকা।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে মূলত মিডল অর্ডারেই ব্যাট করছিলেন হৃদয়। বেশির ভাগ সময় খেলেছেন পাঁচ নম্বরে। ছয়ে খেলেন দুটি ইনিংস, তিনে একটি। ব্যাটিং অর্ডারে যদিও পাঁচ-ছয় নম্বরের কাছাকাছিই সাত নম্বর, তবে ভূমিকায় পার্থক্য বিশাল। সেখানে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাত নম্বরে নেমে বেশ ধুঁকেছেন হৃদয়। ৬১ বলে ৩৯ রানের ইনিংস খেলে তিনি আউট হন হাঁসফাঁস করতে করতে। পরের ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও ছিলেন একদম জড়সড়। আউট হন ২৫ বলে ১৩ রান করে।
তার ব্যাটিংয়ে স্পষ্টই ফুটে উঠেছে, সাত নম্বরেরর ভূমিকাটায় একদমই মানিয়ে নিতে পারছেন না।
যদিও কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, প্রতিটি ম্যাচ ধরে সম্ভাব্য ব্যাটিং পজিশন তারা আগেই সাজিয়ে ব্যাটসম্যানদের জানিয়ে দিয়েছেন এবং সেভাবেই তাদেরকে অনুশীলন করানো হয়েছে। কিন্তু অনুশীলন আর ম্যাচ তো এক নয়!
সাত নম্বর পজিশন এমন একটি জায়গা, যেখানে উপযুক্ত একজনকে অনেক বছর ধরে খুঁজেও পায়নি দল। সেখানে হৃদয় হুট করেই নেমে উপযোগী হয়ে উঠবেন, সেটিও বিশ্বকাপের মতো জায়গায়, এই আশা করাটাই তো তার প্রতি অন্যায়।
সবশেষ ম্যাচে পুনেতে ভারতের বিপক্ষে আবার তাকে পাঁচে উঠিয়ে আনা হয়। কিন্তু আগের সেই হৃদয়কে পাওয়া যায়নি। বরং তার ৩৫ বলে ১৬ রানের ইনিংস দলের মোমেন্টাম নষ্ট করে দেয় অনেকটা। হৃদয়ের ব্যাটিংয়ে স্পষ্ট ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।
দল থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, ব্যাটিং পজিশন নিয়ে কোনো ব্যাটসম্যানের অভিযোগ-আপত্তি নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটা আসলে খাটেও না। দলের প্রয়োজনকে নানা জনকে নানা জায়গায় ব্যাট করতেই হতে পারে। এই মানিয়ে নেওয়াটাও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যেই পড়ে। হৃদয় সেই চ্যালেঞ্জ এখানে নিতে পারেননি। তার সেই ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে একজন উঠতি ব্যাটসম্যান সাত নম্বরের মতো কঠিন ভূমিকায় প্রথমবার খেলা শুরু করবেন বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে, এই চ্যালেঞ্জ তো একটু বেশিই কঠিন! সাতে খেলা মানে স্কিল ও মানসিকতার অনেক বড় সমন্বয়। সেটির জন্য সময় লাগতেই পারে।
দল যেহেতু তাকে নতুন ভূমিকায় বাজিয়ে দেখেছেন, তিনি চাইতেই পারেন যে দল তার ওপর আরেকটু আস্থা রাখবে! এখানেই নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতে পারেন হৃদয়।
এশিয়া কাপের সময় একটি সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে প্রশ্নে সাকিব বলেছিলেন, “রিয়াদ ভাইয়ের জায়গায় যখন কাউকে আনা হয়েছিল দলে, সেটা ছিল তাওহিদ হৃদয়।” অধিনায়কের ইঙ্গিত ছিল, হৃদয় এত ভালো খেলছেন যে মাহমুদউল্লাহর জায়গাই নেই। এখন সেই মাহমুদউল্লাহই আছেন একাদশে, কিন্তু হৃদয় নেই।
বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ যেভাবে খেলেছেন, বিশেষ করে গত ম্যাচে যেভাবে ব্যাট করেছেন, এরপর তাকে একাদশের বাইরে রাখা কঠিন। একাদশের বিবেচনায়ও দল তার সেই ফর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু দল থেকেই তো বারবার বলা হয় ‘প্রসেস’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হৃদয় প্রশ্ন করতেই পারেন, তার ক্ষেত্রে কি সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে?
ফর্ম আর প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্ব আসলে চলতেই পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দলে, যেভানে পারফর্মার খুব বেশি নেই। একাদশে ৬ বোলার খেলাতে চাইলে একটি সিদ্ধান্ত নিতেই হতো এবং টিম ম্যানেজমেন্ট সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হৃদয়কেই বাইরে থাকতে হয়েছে।
তবে হৃদয়ের মনে হতেই পারে, ব্যাটিং অর্ডারের এই টানাপোড়েন না থাকলে হয়তো তাকে বাদ দেওয়া এতটা সহজ হতো না!