অক্সফোর্ডের টিকা কি রাজনীতির শিকার?

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ছিল একটি ব্রিটিশ সাফল্যের গল্প। সেটা ছিল যুক্তরাজ্যের নিজস্ব সক্ষমতায় টিকা উদ্ভাবন এবং মহামারী শুরুর এক বছরের মধ্যে বাজারে সরবরাহ শুরু করতে পারার সফলতা। প্রত্যাশা ছিলো বিশাল- এ টিকা হবে পুরো বিশ্বের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2022, 06:18 PM
Updated : 7 Feb 2022, 06:18 PM

কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে বিশ্ব রাজনীতি আর জাতীয়তাবাদ কী বাধা হয়ে উঠেছে? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

এক প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্যের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা নিয়েছেন। ধারণা করা যায়, ফাইজার ও মডার্নার মোট টিকার তুলনায় বেশি মানুষের জীবনকে সুরক্ষা দিতে পেরেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।

অথচ যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে এখন এ টিকার ব্যবহার প্রায় হচ্ছেই না। সেখানে এ পর্যন্ত তিন কোটি ৭০ লাখ নাগরিক বুস্টার ডোজ পেয়েছেন, যাদের মধ্যে মাত্র ৪৮ হাজার নিয়েছেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাকে মূল সারিতে রাখা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এ টিকার অনুমোদনই দেয়নি এখনও।

কীভাবে এ পরিস্থিতিতে পড়ল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা?

ব্রিটিশ মন্ত্রীরা এ টিকাকে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের জন্য ব্রিটেনের উপহার’। অথচ সেই টিকা এখন নিজভূমেই উপেক্ষিত।

এ টিকাকে পরীক্ষাগার থেকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত গবেষক দলের কেন্দ্রে ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্যার জন বেল। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার এমন দশার জন্য তিনি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের দিকে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “তারা (ইইউর নীতি নির্ধারকেরা) এই টিকার সুনাম এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যা বিশ্বের সব প্রান্তে সমানভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আমি মনে করি বিজ্ঞানী ও রাজনীতিকদের বাজে আচরণ সম্ভবত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী; এবং এ নিয়ে তাদের গর্ব করার কিছু নেই।”

তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা মিলবে একটু পেছনে তাকালে, ২০২১ সালের শুরুর দিকে। করোনাভাইরাসের আলফা ধরনের সংক্রমণে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলোতে তখন রোগীর উপচে পড়া ভিড়, বেড়ে চলেছে মৃত্যু, হিমশিম অবস্থা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার।

তবে সেটা ছিল আশাবাদী হওয়ারও সময়, কারণ ফাইজার-বায়োএনটেক ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তখন চলে এসেছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য এ দুই টিকার অনুমোদনও দিয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, অক্সফোর্ডের টিকা উদ্ভাবনকে সে সময় যুক্তরাজ্যের একটি সাফল্যের নজির হিসেবে উৎযাপন করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল, এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োসায়েন্সেস এবং শিক্ষাঙ্গনের শক্তিশালী অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। ব্রিটিশ সরকার এমনকি টিকার ভায়ালের গায়ে ইউনিয়ন পতাকার ছবিও দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা তাতে অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। টিকার গায়ে ব্রিটিশ ছাপ রাখতে চাননি তারা, কারণ মহামারী কোনো সীমানা মানে না। বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং অরক্ষিত দেশগুলোতে ভাইরাসের রূপ বদল ঠেকানো।

এ টিকার উদ্ভাবন হয়েছে যে পরীক্ষাগারে, অক্সফোর্ডের সেই জেনার ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল বিবিকে বলেছেন, “অনেক বেশি জাতীয়তাবাদ সামনে চলে এসেছিল। বিভিন্ন দেশের মধ্যে টিকার ধরন নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিযোগিতা যখন চলছে, তখন সেটা (জাতীয়তাবাদী চেতনা) ছিল মহামারী নিয়ন্ত্রণে এবং বিশ্বের সবখানে টিকা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি।”

যুক্তরাজ্যে এ টিকার অনুমোদন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের আলাদা হওয়াটা কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে হয়েছে। স্যার জন বেল বলেন, “এ টিকাকে ব্রিটিশ টিকা হিসেবে প্রচার করাটা; আমি মনে করি না এটা ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক সহজ করতে কোনো প্রভাব ফেলেছে।”

কোভিড মহামারীর শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য ব্যাপক প্রাণহানির পর টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সার্বিক পরিবেশ ছিল সব মিলিয়ে উৎসাহব্যাঞ্জক। অন্যদিকে টিকার যোগান নিশ্চিত না হওয়ায় ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের তখন মন খারাপ।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভ্যাকসিন কনট্যাক্ট গ্রুপের ড. ভেরোনিক ট্রিলেট-রেনয়ির বলেন, “আমরা যেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম যুক্তরাজ্যে লাগাতার টিকাদান চলছে অথচ আমরা টিকা পাচ্ছি না।”

জানুয়ারির শেষ দিকে ইইউ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু ইউরোপের নিয়ন্ত্রক সংস্থা টিকার পূর্ণ অনুমোদন দেওয়ার আগেই জার্মানি সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের অক্সফোর্ডের টিকা দেবে না।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও টিকার সমালোচনা করেন। তবে এর কয়েক ঘণ্টা পর ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি সব বয়সী প্রাপ্তবয়স্কের জন্য এ টিকার অনুমোদন দেয়। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত বদলায় জার্মানি ও ফ্রান্স।

কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে, ফ্রান্সের অনেক চিকিৎসক অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন কারণ মানুষ তখন ওই টিকায় আস্থা পাচ্ছিল না। কেন এমনটি হল?

বিবিসি লিখেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সবগুলো পরীক্ষার পুরো ফল হাতে পাওয়ার আগেই এ টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া মার্চের দিকে বেশকিছু ঘটনা ধরা পড়ে, যেখানে দেখা যায়, বয়স্ক ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেধে যাচ্ছে এই টিকা দেওয়ার কারণে।

অবশ্য সেই সংখ্যা ছিল নেহাতই কম। প্রতি ৬৫ হাজারে একজনের এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। পরে ইউরোপের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঘোষণা করে, সার্বিক যে সুরক্ষা এই টিকায় মিলছে, সে তুলনায় ওই রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায়। আরও পরে চিকিৎসকরা এর চিকিৎসাও বের করেন।

অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার আরেকটি জটিলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। টিকার উৎপাদন যুক্তরাজ্য ও ইইউতে হলেও চুক্তি অনুযায়ী টিকা প্রাপ্তিতে যুক্তরাজ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ছিল। ফলে অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের যুক্তরাজ্যের প্ল্যান্টে উৎপাদিত টিকা ইইউতে পাঠাতে পারছিল না। অথচ ইইউর কারখানা থেকে ১০ লাখ ডোজ টিকা যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছিল।

বিষয়টি কূটনৈতিক টানাপড়েনের সৃষ্টি করে। সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইউরোপীয় কমিশন হুমকিও দিয়ে বসে যে তারা যুক্তরাজ্যে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেবে, যদি তাদের ন্যায্য হিস্যা দেওয়া না হয়।

যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে অক্সফোর্ডের টিকা নিয়ে যথেষ্টই আস্থা ও গর্ব ছিল, এমনকী যখন রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টির কারণে ৪০ বছরের বেশি বয়সীয়দের জন্য এ টিকা প্রয়োগ স্থগিত করা হল, তখনও।

কিন্তু যখন বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হল, তখন রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টির পাশপাশি এমআরএনএ নির্ভর ফাইজার ও মডার্নার টিকার সহজপ্রাপ্যতা এবং বয়স নিয়ে কোনা সীমাবদ্ধতা না থাকার সুবিধা অক্সফোর্ডের টিকার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল।

যুক্তরাজ্যে বুস্টার ডোজ হিসেবে অনুমোদন থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ অক্সফোর্ডের পরিবর্তে মডার্না ও ফাইজারের টিকাই পাচ্ছে এখন।

ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাকে ‘অনিরাপদ বা কম কার্যকর’ টিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে; বেলজিয়ামে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলদি ভ্যাকসিন’ বা সস্তার টিকা।

অথচ টিকাটি উদ্ভাবন করাই হয়েছে এমনভাবে, যাতে এর দাম কম থাকে, বিশ্বজুড়ে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এটা বাজারজাত করা যায়। এমআরএনএ টিকার তুলনায় এই টিকা পরিবহন ও সংরক্ষণ সহজতর এবং বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই টিকা প্রয়োগ করা যায়।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের টিকা বিক্রি করে লাভ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের কারণে টিকার প্রতি ডোজের দাম হয় ৩ ব্রিটিশ পাউন্ডের কম, যা ফাইজারের টিকার দামের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ।

অথচ এই সাশ্রয়ী টিকা নিয়ে আরও একটি সংকট দেখা দেয় ভারতে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়ার পর।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন ও বিপণন পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বিশ্বের শীর্ষ টিকা উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। 

সেরাম ইনস্টিটিউট কথা দিয়েছিল, তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার লাইসেন্স নিয়ে ভারতে এ টিকা উৎপাদন করবে এবং একশ কোটির বেশি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে। 

কিন্তু ২০২১ সালের বসন্তে ডেল্টা যখন ভারতকে গ্রাস করে নিল, সেদেশের সরকার আগে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য টিকা রপ্তানি বন্ধ করে রাখল ছয় মাসের বেশি সময়।

তাতে টিকা সরবরাহে আন্তর্জাতিক সঙ্কটের তৈরি হল, কারণ ধনী দেশগুলো যখন ফাইজার আর মডার্নার টিকার আগাম অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্ত, তখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই ছিল দরিদ্র দেশগুলোর একমাত্র ভরসা।

নিম্ন আর মধ্যম আয়ের দেশগুলোও তখন আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ওপর ভরসা রাখতে পারল না, বিশেষ করে সেসব দেশের রাজনীতিবিদ আর নীতি নির্ধারকরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড. ব্রুস আইলওয়ার্দ বিশ্বজুড়ে টিকার ন্যায্য বণ্টনের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখছেন। তার মতে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়েও এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

অবশ্য এতকিছুর পরও বিশ্বে এ পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ১৮৩টি দেশে এ টিকার ২৫০ কোটি ডোজ এরইমধ্যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেই দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশ।

অ্যাস্ট্রাজেনেকার ধারণা, তাদের টিকা এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।

এ কোম্পানির  প্রধান নির্বাহী প্যাসকাল সরিয়ট বলেন, “মানুষকে আপনি বদলাতে পারবেন না। সবাই আগে নিজের ভালোটা দেখবে, তারপর প্রতিবেশীরটা, তারপর দুনিয়ার বাকিদের কথা ভাববে।

“আপনি হয়ত তেমন একটা পরিস্থিতি আশা করতে পারেন, যেখানে টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বলে কিছু থাকবে না, যাদের প্রয়োজন বেশি, তাদের দ্রুত টিকা সরবরাহে কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতাটা আপনাকে মেনে নিতে হবে।”