ওমিক্রনেই মহামারীর ইতি?

মহামারীর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গত নভেম্বরের শেষে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরন ওমিক্রনের আবির্ভাবের পর ভয়ঙ্কর এক পরিণতির কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্ব।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Jan 2022, 07:04 PM
Updated : 23 Jan 2022, 07:04 PM

দুই মাস না যেতেই বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস নিয়ে সাধারণের ধারণা পাল্টে যেতে শুরু করেছে।

সিএনএন লিখেছে, অনেকেই ভাবছেন, এ ভাইরাস দ্রুত ছড়াচ্ছে বটে, কিন্তু মৃত্যু ঘটাচ্ছে কম। সুতরাং এত ভয়ের কী আছে!

মানুষের কোভিড দর্শন নিয়ে গবেষণা করা সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির সিমন উইলিয়ামস বলেন, “আগের ধরনের চেয়ে ওমিক্রন নিয়ে শঙ্কার মাত্রা কমে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কোভিড নিয়ে অনেকেরই ভয় কমে গেছে।”  

তিনি বলেন, ওমিক্রনে আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থতায় ভুগতে হচ্ছে আগের ধরন ডেল্টার চেয়ে কম। তাছাড়া অনেকের মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, সবারই ওমিক্রনে আক্রান্ত হতে হবে। আর এ মানসিকতা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা এনে দিচ্ছে।

এমনকি এই ওমিক্রনের ঢেউয়ের মধ্য দিয়েই মহামারীর অবসানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কিছু মানুষ। তাদের কারও কারও কথায় হয়ত যুক্তি আছে, কিন্তু কিছু মানুষ আবার স্বেচ্ছায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন, যা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ওমিক্রনই যে মহামারীর শেষ ধাপ হতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন বলছেন, তবে তারা সেটা বলছেন সতর্কতা রেখেই। বিশ্বব্যাপী ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধের একটি স্তর তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরছেন তারা।

ছবি: রয়টার্স

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ অঞ্চলভিত্তিক সাধারণ রোগে পরিণত হয়ে এনডেমিক পর্যায়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এক সময় তা মৌসুমি সর্দি-জ্বরের মতোই হয়ে উঠতে পারে।

এর মানে হল বিভিন্ন অঞ্চলে এই রোগটি থাকবে, মানুষ আক্রান্তও হবে, তবে এর প্রকোপ এবং ভয়াবহতা হবে মহামারী পর্যায়ের চেয়ে অনেক কম, এ রোগের ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মহামারীজনিত সংক্রমক রোগের অধ্যাপক ডেভিড হেইমান বলেন, “আমার দৃষ্টিতে এটা এনডেমিক হয়ে যাচ্ছে এবং এটা এনডেমিক পর্যায়ে বেশ কিছু কাল থাকবে- অন্যান্য করোনাভাইরাসে ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে।

“সকল ভাইরাসই এনডেমিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, এবং আমার কাছে মনে হচ্ছে এটাও সে দিকেই এগোচ্ছে।”

বিশেষজ্ঞরা এর আগে বলেছিলেন, কোভিড-১৯ ধারনার চেয়েও অনেক বেশি রূপ পরিবর্তন করেছে এবং আগের ডেল্টা ধরনকে ছাড়িয়ে যাওয়া ওমিক্রন আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু বিশ্ববাসী এখন এমন একটি ধরন পেয়েছে যা খুব সহজেই সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে, তবে আগের ধরনের চেয়ে হাসপাতালে ভর্তি, গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর হার কম দেখা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন- ওমিক্রন যেমন অপ্রত্যাশিতভাবে আবির্ভূত হয়েছে, এর পরের ধরন হয়ত আরও গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে হাজির হতে পারে, তাতে মহামারী আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবে।

অনেক দেশেই, বিশেষ করে যেখানে টিকা দেওয়ার হার কম, সেসব দেশে ওমিক্রনের ঢেউয়ে হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখা দিতে পারে।  

সিএনএন লিখেছে, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসার চেষ্টা এবং চাপের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিকভাবে একটি জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়েছে।

তাদের সামনে বিকল্প দুটি। শ্রমশক্তি এবং অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে আগের মত লকডাউন দেওয়া যায়, অথবা মানুষকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা যায়। এর মধ্যে একটি তারা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। 

ছবি: রয়টার্স

পাল্টে যাওয়া সূত্র 

কোভিড-১৯ যাতে ২০২২ সালের মধ্যে এনডেমিক পর্যায়ে নেমে আসে, বিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক নেতাদের বড় অংশই মনেপ্রাণে সেটা চাইছেন। তবে কবে নাগাদ সেটা হতে পারে সেই প্রশ্নটি অমীমাংসিত।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মানুষের জীবন থেকে কোভিড পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার মত কোনো আশা এখনও দেখছেন না। তাদের ধারণা, এর সঙ্গেই মানুষকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে, যেমনটা অন্যান্য রোগ শোক নিয়ে মানুষ থাকে।

মহামারীর প্রাথমিক পর্যায় নিয়ে একটি বইয়ের লেখক ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এর মহামারীজনিত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মার্ক উলহাউজ বলেন, “সম্ভবত এটা অনেকবার ঘটবে। বারবার সংক্রমণের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে একটি ইমিউনিটি তৈরি হবে। এমন একটা পরিস্থিতির দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”

তিনি বলেন, ওমিক্রন হচ্ছে ভাইরাসের আরেকটি ডোজ। এই ডোজের মাধ্যমে গড়পড়তা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে। তা না হলে টিকার মাধ্যমে সেটা ঘটবে।

ওমিক্রনে আক্রান্তদের ঝুঁকি কমে আসার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটা ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতার একটা বাড়তি স্তর তৈরি করছে অতিরিক্ত প্রাণক্ষয় ছাড়াই।

স্কটিশ একটি সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি দুই তৃতীয়াংশ কম। দক্ষিণ আফ্রিকার আলাদা একটি প্রতিবেদনেও একই কথা বলা হয়েছে এবং সেটা ৮০ শতাংশ।

মহামারীজনিত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মার্ক উলহাউজ বলেন, “বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন হয় ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন, নয়তো টিকা নেবেন। ভাইরাসের অবস্থান থেকে দেখলে পুরো খেলাটাই পাল্টে গেছে।”

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে মহামারীর ইতিহাস। যদিও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতের মহামারীর তুলনা করতে যাওয়াটা সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত নয়।

বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ভাইরাসটি রূপান্তরিত হতে হতে কম গুরুতর একটি সংস্করণে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন সেটা বছরে কোনো এক সময় ঠাণ্ডা কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপের মত দেখা দেবে।

ছবি: রয়টার্স

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মহামারীজনিত সংক্রমক রোগের অধ্যাপক ডেভিড হেইমান বলেন, “ইতোপূর্বে আরও চারটি করোনাভাইরাস এরকম এনডেমিকে পরিণত হয়েছে। সংক্রমণের স্বাভাবিক ইতিহাস পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, সার্স-কোভ-২ হয়ে উঠবে সেই তালিকার পঞ্চম ভাইরাস।”

মার্ক উলহাউজ বলেন, ১৯ শতকের শেষ দিকে ‘রাশিয়ান ফ্লু’র প্রাদুর্ভাব পরে সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত রোগের পরিণত হয়েছে।

১৮৮৯ থেকে ৯০ সালে রাশিয়ান ফ্লুর কারণে প্রায় ১০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ওই রোগও হয় একটি করেোনাভাইরাসের কারণে। 

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু সারা বিশ্বকে এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অত্যন্ত বাজে অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। এখন মানুষ প্রতি বছর ওই ভাইরাসের একটি ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়। 

সিএনএন লিখেছে, বিশেষজ্ঞরা সাধারণভাবে একমত যে, ওমিক্রন কোভিড- ১৯ এর ক্ষেত্রে পৃথিবীকে সেই অবস্থানের ‘কাছাকাছি’ নিয়ে গেছে। তবে কত দ্রুত তা চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাবে তা এই ওমিক্রনের ওপর নির্ভর করবে না। এ ভাইরাসের পরবর্তী ধরনগুলো কেমন হবে, তার ওপরই নির্ভর করতে এর গতিপথ।

মার্ক উলহাউজ বলেন, “ এখন এটা কম বিপজ্জনক মানে এই নয় যে নতুন একটি ধরন আসবে না এবং আমাদের পিছু হটতে বাধ্য করবে না। পরবর্তী ধরনটি কেমন হবে সে বিষয়ে আগাম কিছু বলতে চাই না।

“তবে ভাইরাসের পরের ধরনটির মধ্যে ওমিক্রনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। মূল বিষয় হচ্ছে শরীরে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং টিকা নেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া ইমিউনিটি এড়িয়ে যাওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।”

“তবে সেটা কতেটা খারাপ হতে পারে, সে বিষয়ে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়।”