মহামারীর মধ্যে সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে ভালো বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংক্রমণ এখন বিক্ষিপ্তভাবে হচ্ছে। তবে আতঙ্ক নিয়ে আসা করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন থেকে সতর্ক থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ওমিক্রম নিয়ে উদ্বেগে এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে।
বিশ্বে নতুন করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ঘটার কয়েক মাস পর ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ে।
ওই বছরের শেষ ভাগ এবং ২০২১ সালের শুরুতে সংক্রমণের হার অনেকটা কম থাকলেও ভারতে উদ্ভূত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে বাংলাদেশে তৈরি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি।
বিপর্যয়কর জুন,জুলাই, অগাস্ট পেরিয়ে সংক্রমণ আবার নিম্নমুখী। তবে তবে গত সপ্তাহ থেকে তা কিছুটা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণের গতি আবার ঊর্ধ্বমুখী। আবার ভারতেও সংক্রমণ আবার বাড়ছে।
শনিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১৫ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় ২৮ হাজার জন।
সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার গত দেড় মাস ধরে তিন শতাংশের নিচে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এত সময় শনাক্তের হার ৩ শতাংশের কম ছিল না।
তবে দেখা যাচ্ছে, গত দুই সপ্তাহ ধরে শনাক্ত এবং গত এক সপ্তাহ ধরে মৃত্যু কিছুটা বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগে সংক্রমণ বাড়ার কথা আসছে।
সীমান্তের সাতটি জেলায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি ছিল বলে উল্লেখ করা হয় ১৫ নভেম্বরের প্রতিবেদনে।
তখন এক সপ্তাহে বাংলাদেশে ১৪৮৮ জন রোগী শনাক্তের কথা বলা হয়েছে। এ সময় রোগী শনাক্তের হার ঢাকায় যেখানে ৫ শতাংশ বেড়েছিল,সেখানে রাজশাহীতে ২৪ শতাংশ এবং খুলনায় ১১ শতাংশ বেড়েছিল।
ডব্লিউএইচওর ২২ নভেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে শনাক্ত রোগী আগের সপ্তাহের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়েছে। এরমধ্যে ৪০ শতাংশ বেশি রোগী বেড়েছে রাজশাহী বিভাগে। ঢাকায় ৯ শতাংশ এবং সিলেটে ১১ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট ও শরীয়তপুর জেলায় করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার ছিল ৬ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে।
যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, মাগুরা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় শনাক্তের হার ৩ থেকে ৫ শতাংশ।
রংপুর, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, রাজবাড়ী, নড়াইল, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায় আগের সপ্তাহের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সপ্তাহভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ৪৫তম ‘এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহ’ (৮ থেকে ১৪ নভেম্বর) সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। নইলে আবার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী সংক্রমণের হারে বোঝা যায় বাংলাদেশ এখনও ভালো অবস্থায় আছে।
“অনেকদিন ধরেই সংক্রমণের হার দেড় শতাংশের নিচে আছে। এটা থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি মহামারী শেষ তাহলে ভুল হবে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। টিকার সরবরাহ এখনও ভালোই আছে। যারা এখনও টিকা নেয়নি, তারা যদি নিয়ে নেয় তাহলে আমরা মনে হয় আমরা এই ধারায় থাকব।”
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন অবস্থায় আছে তা বোঝা যায় চার বিষয় বিবেচনা করে। এগুলো হলো- বাংলাদেশে কোনো সংক্রমণ নেই কিন্তু বাইরের দেশে আছে, দ্বিতীয় পর্যায় হলো স্পোরাডিক কেইস অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে সংক্রমণ হওয়া, তৃতীয়ত ক্লাস্টার বা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সংক্রমণ এবং শেষের ধাপ হচ্ছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অর্থাৎ যখন ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।
“সে হিসেবে সংক্রমণের নিম্নমাত্রায় আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে। এটা কয়েক সপ্তাহ ধরেই আছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, কয়েক সপ্তাহ শূন্য সংক্রমণ থাকলেও স্বস্তির কিছু নাই। দেশে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে কিংবা বিদেশে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণও বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
“ইউরোপের অনেক দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। কাজেই সংক্রমণ আবার হওয়ার আশঙ্কা পুরো মাত্রায়ই আছে। ডেল্টার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে। যদিও নতুন করে কোন ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তা এখনও জানা যায়নি।”
তবে টিকাদান যত বেশি হবে, আশঙ্কা ততটাই কমে আসবে বলে তার মত।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার কম হলেও তা ‘এলার্মিং’।
“সংক্রমণ শূন্যতে নামে নাই। এটা থেকে যে বাড়বে না, তা বলা মুশকিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকায় আবার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ঝুঁকি হচ্ছে আমাদের যদি ক্রসবর্ডার দিয়ে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট আসে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেওয়া ভ্যাকসিন যদি কাজ না করে, তখন ম্যাসিভ ওয়েভ আসতে পারে। এজন্য আমাদের সার্ভিলেন্স খুব কঠোরভাবে করতে হবে। দেখতে হবে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট আসছে কি না।”
অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লাহ মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারি বা মার্চে সংক্রমণ আবার কিছুটা বাড়তে পারে। তবে তা গত জুলাইয়ে যে পরিস্থিতি ছিল, সে ধরনের হওয়ার সম্ভাবনা নাই।