কর্মক্ষেত্রে পলিথিনের খোপ কোভিড থেকে বাঁচাবে?

কোভিড সংক্রমণ থেকে বাঁচার আশায় অনেক দেশে কারখানায় স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে খোপ তৈরি করে কর্মীদের মাঝে তৈরি করা হচ্ছে প্রতিবন্ধক; দোকানে বা স্কুলেও নেওয়া হচ্ছে এ ধরনের ব্যবস্থা। তাতে আদৌ কোনো সুরক্ষা মিলছে?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2021, 06:44 PM
Updated : 21 August 2021, 06:44 PM

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, সাধারণভাবে মনে হতে পারে, ওই স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বাধা হয়ত ভাইরাসকে আটকে দেবে।  কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পলিথিনের বেড়া হয়ত কেবল মানসিক স্বস্ত্বিই দিচ্ছে; তাতে সুরক্ষার বদলে পরিস্থিতি কখনও কখনও খারাপই হতে পারে।

অনেক দোকানের ক্যাশ কাউন্টারেই এখন এরকম স্বচ্ছ পলিথিন বা প্লেক্সিগ্লাস বসানো হয়েছে, যাতে ক্রেতার কাছ থেকে জীবাণু ক্যাশে বসে থাকা কর্মীর কাছে পৌঁছাতে না পারে।

গবেষণা বলছে, এরকম প্রতিবন্ধকে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। কারণ সেখানে বাধা পেয়ে জীবাণু ছোট একটি জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকলে তাতে দোকানের অন্য কর্মী এবং ক্রেতারাও সংক্রমিত হতে পারেন। 

কিছু কারখানায় কর্মীদের সুরক্ষা দিতে তাদের বসার জায়গা ঘিরে স্বচ্ছ পলিথিনের খোপ তৈরি করা হয়েছে, অনেক দেশে অফিস বা ক্লাসরুমেও এমন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে ঘরের ভেতর স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ বা ভেন্টিলেশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।  

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় দোকান, ক্লাস রুম বা অফিস কক্ষে শ্বাসের মাধ্যেমে যেসব কণা বাতাসে মিশছে, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বা বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা ঠিক থাকলে ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে তা বাতাসে ভেসে বেরিয়ে যায় এবং সেই জায়গা নেয় তাজা বাতাস।

কিন্তু ঘরের ভেতরে ডেস্ক বা টেবিল ঘিরে যদি পলিথিন বা প্লাস্টিক বা প্লেক্সিগ্লাস দিয়ে কিউবিকলের আদলে খোপ তৈরি করা হলে তাতে ঘরে বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। স্বাভাবিক ভেন্টিলেশনও হয় না। ফলে ঘরে আটকা পড়া বাতাসে ভাইরাল কণা বাড়তে থাকে এবং সবার সংক্রমিত হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

ভার্জিনিয়া টেকের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগের অধ্যাপক লিনসে মার ভাইরাল সংক্রমণের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। 

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, “আপনি যদি ঘরের মধ্যে এরকম ব্যারিয়ারের জঙ্গল বানিয়ে রাখেন, তাহলে সেখানে ঠিকভাবে ভেন্টিলেশন সম্ভব না। সবার শ্বাসের সঙ্গে যে কণা বাতাসে মিশছে, সেটা তখন ওই ঘরের মধ্যে এবং প্রতিটা খোপের মধ্যে আটকে থাকবে। এভাবে বাতাসে ভাইরাল কনার ঘনত্ব বেড়ে যাবে। ভাইরাস তখন আর কোনো একটা খোপে আটকে থাকবে না, আশপাশে ছড়াবে।”   

এ ধরনের স্বচ্ছ প্রতিবন্ধক কখনও কখনও কিছু সুরক্ষা দিতে পারে, তবে সেটা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। হাঁচি বা কাশির সঙ্গে যে ভাইরাল কণা ছিটকে আসে, সেটা এই প্লাস্টিক বা প্লেক্সিগ্লাসের প্রতিবন্ধক হয়ত ঠেকিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু যে আকারের ভাইরাল কণার মাধ্যমে কোভিড ছড়ায়, তা খালি চোখে দেখা যায় না। পলিথিনের খোপ করে সেসব ভাইরাল কণার প্রবাহ কতটা ঠেকানো যায়, সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত গবেষণা এখনও হয়নি। 

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তাতে প্রথামকিভাবে যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, তা ওই পলিথিনের ব্যারিয়রের পক্ষে যাচ্ছে না।

গত জুনে জনস হপকিন্সের গবেষকরা এ ধরনের একটি কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, ক্লাস রুমে ডেস্কের চারপাশে ওরকম প্লাস্টিকের খোপ তৈরি করলে তাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ে। 

জর্জিয়ার গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, স্কুলে শিক্ষার্থীদের ডেস্ক ঘিরে প্লাস্টিকের ব্যারিয়ার দিলে তাতে করোনাভাইরাস ছড়ানো আটকায় না। বরং স্বাভাবিক শ্রেণিকক্ষে আরও বেশি বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করলে এবং মাস্ক পরা নিশ্চিত করলে সুরক্ষার সম্ভাবনাও বাড়ে। 

করোনাভাইরাসের এই মহামারী আসার অনেক আগে, ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, যক্ষার মত রোগের ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব বিষয় সহায়ক ভূমিকা রাখে, অফিসের কিউবিকল ডিভাইডার তার একটি।  

দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের সামনে প্লেক্সিগ্লাস দিয়ে যে ধরনের প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়, সেরকম মডেল বানিয়ে একটি গবেষণা করেছেন ব্রিটিশ গবেষকরা।

তাতে দেখা গেছে, ওই ব্যারিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি হাঁচি বা কাশি দেয়, তার মুখ থেকে ছিটকে আসা কণা ওই প্লেক্সিগ্লাস আটকে দিচ্ছে। কিন্তু কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তির শ্বাসের মাধ্যমে যে কণা বাতাসে মিশছে, তা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে।

ফলে দোকানের কর্মীরা বা অন্য ক্রেতাদের সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এমনকি বাতাসে ভেসে সেই ভাইরাল কণা ব্যারিয়ারের অন্য পারেও যেতে পারে, তাতে ওপাশের ক্যাশিয়ারও আর সুরক্ষিত থাকছেন না।  

ইউনিভার্সিটি অব লিডসের এনভারনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ক্যাথরিন নোয়াকিস বলেন, ঘরের বাতাসে যদি কারও শ্বাসের মাধ্যমে যদি ভাইরাস ছড়ায়, আর তারপর অন্য কেউ যদি কয়েক মিনিটও সেখানে থাকেন, তার সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে, প্লেক্সিগ্লাসের ব্যারিয়ার কারও কোনো কাজে আসবে না। 

তিনি বলেন, ২০১৩ সালে হাসপাতালের বেডের চারপাশে পর্দা দেওয়ার ওপর একটি গবেষণা করেছিলেন তারা। দেখা গিয়েছিল, পর্দা দিয়ে আশপাশের মানুষের কাছ থেকে আসা জীবাণু থেকে হয়ত একজন রোগীকে কিছুটা সুরক্ষা দেওয়া যায়, কিন্তু ওই পার্টিশনের কারণেই বাতাসের মাধ্যমে ভেসে আসা জীবাণুতে চারপাশে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।  

“বিশেষ করে ক্লসরুমের মত জায়গায়, যেখানে একসাথে অনেক বেশি মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে থাকে,সেখানে এরকম ব্যারিয়ার তৈরি করলে উপরের বাতাসে জীবাণুর ঘনত্বের ভিত্তিতে একেকটা পকেট তৈরি হয়, কোনোটা কম ঝুঁকির, আবার কোনোটা বেশি ঝুঁকির। কারও পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না।”

পলিথিন দিয়ে ছোট ছোট খোপ তৈরি করে তার ভেতরে কর্মীদের বা শিক্ষার্থীদের বসতে দিলে কেন তাতে ভাইরাল কণা থেকে সুরক্ষা মিলবে না, সেটা বোঝাতে সিগারেটের উদাহরণ দিয়েছেন অধ্যাপক লিনসে মার।

তিনি বলেন, হাঁচি-কাশির সঙ্গে মুখ থেকে ছিটকে আসা লালা বা জলকণা হয়ত ওই পলিথিনের প্রতিবন্ধক আটকে দেবে, কিন্তু শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসা ভাইরাল কণা বাতাসে মিশে থাকে সিগারেটের ধোঁয়ার মতই।

ওই ধোঁয়া যেমন বাতাসে ভেসে এক কিউবিকল থেকে পাশের কিউবিকলে যেতে পারে, ভাইরাল কণার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। পাশের কিউবকলে বসা লোকটি যেমন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেসে আসা সেই ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে বুকে টেনে নেন, একইভাবে ভাইরাসের কণা তার ফুসফুসে চলে যাবে, তিনি সেটা বুঝতেও পারবেন না।

আর কিউবিকলের মধ্যে সিগারেট ধরালে যেমন ধোঁয়া অনেকক্ষণ আটকে থাকে, বাতাসে ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়, ভাইরাল কণার ক্ষেত্রেও তাই হবে। ওই নির্দিষ্ট খোপের ভেতর ভাইরাল কণার ঘনত্ব বেড়ে যাবে, যতক্ষণ না বাইরের বাতাসে মিশে তা হালকা হতে পারছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে সবাইকে সুরক্ষা দিতে হলে সবার আগে জোর দিতে হবে করোনাভাইরাসের টিকার ওপর। সেই সঙ্গে ঘরে বায়ু চলাচল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে যান্ত্রিক এয়ার ফিলটারের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সবার মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।