নিবন্ধনের কিছু শর্ত শিথিল এবং সরকার গণটিকাদান শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি দেখা দিলেও মানুষ যেভাবে টিকাকেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, সবার জন্য টিকার জোগান নিয়ে চিন্তাও করতে হচ্ছে।
প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর মিলছে, চাহিদার তুলনায় মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় অনেককেই ফিরতে হচ্ছে টিকা না নিয়ে। কেউ কেউ দুই তিন দিন ঘুরেও টিকা নিতে পারছেন না।
বুধবার গণটিকাদান কর্মসূচির পঞ্চমদিনেও রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
টিকা পেতে কোনো কোনো কেন্দ্রে আগের রাত থেকেই লাইন ধরছেন মানুষজন। গাদাগাদি, হুড়োহুড়িও চলছে। কিন্তু বিপুল চাহিদার তুলনায় টিকা কম থাকায় শেষ পর্যন্ত অনেককেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
শুরুতে ৭ অগাস্ট থেকে এক সপ্তাহে কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক। পরে লক্ষ্যমাত্রা অনেক কমিয়ে শনিবার থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গণটিকাদান শুরু হয়।
এই কর্মসূচির পর ১৪ অগাস্ট থেকে আবার গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আবার এই কর্মসূচি চলবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। টিকার পর্যাপ্ততার ওপর পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে।
গণটিকাদান কর্মসূচির ছয়দিন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩৫০ জনকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে মানুষের ভিড় এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় কেন্দ্র আসা অনেকেই টিকার বাইরে থাকছেন।
বুধবার মিরপুরের ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়ে ভিড় করেন হাজারেরও বেশি মানুষ।
এখানে টিকা নিতে আসা আনোয়ারা বেগম জানান, সকাল থেকে অপেক্ষা করলেও টিকা পাবেন কিনা সে চিন্তায় আছেন।
“গতকাল (মঙ্গলবার) এসে ঘুরে গেছি। আজকে একটু আগে আসছি। এর আগেই তো অনেক মানুষ এসে গেছে।”
কোভিডের টিকায় মানুষের আগ্রহ বাড়ায় গণটিকাদান কেন্দ্রের পাশাপাশি নিয়মিত কেন্দ্রগুলোতেও হিমশিম অবস্থা।
বেলা ১১টার দিকে পল্লবীর নগর মাতৃসদনে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে কয়েকশ মানুষের ভিড় দেখা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মাত্র ৫০টি টিকা রয়েছে জানিয়ে অন্যদের চলে যেতে বলেন এখানকার কর্মীরা।
বেসরকারি চাকুরে আক্তার হোসেন জানান, দুইদিন ধরে আসছেন, কিন্তু টিকা পাননি।
“অনেকদিন অপেক্ষা করে মেসেজ পাইনি। মেসেজ যখন আসলো তখন টিকা পাচ্ছি না। আজ মডার্নার টিকার শেষ দিন, এই টিকাটা নিতে চেয়েছিলাম। সেটা তো আর হচ্ছে না।”
মুঠোফোনে মেসেজ আসেনি এমন অনেকেও টিকা কার্ড নিয়ে এই কেন্দ্রে এসেছিলেন।
তাদের একজন পলাশ মাহমুদ বলেন, “১৪ জুলাই রেজিস্ট্রেশন করছি। এখনও মেসেজ পাইনি। শুনছিলাম, মেসেজ ছাড়াই কার্ড নিয়ে এলে টিকা পাব। কিন্তু এখানে মেসেজ ছাড়া কাউকে টিকা দিচ্ছে না। কবে এসএমএস আসবে, কবে আমরা টিকা পাব?”
এই কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী ইসরাফিল ইসলাম বলেন, “শুরুর দিকে মানুষ টিকা নিতে আসেনি। এখন দম ফেলতে পারছি না। মানুষ আসছে, কিন্তু বরাদ্দ না থাকলে তো সবাইকে আমরা দিতে পারব না।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানান, বিভিন্ন ওয়ার্ডে টিকা না পেয়ে প্রতিদিনই অনেক মানুষ ফিরে যাচ্ছেন।
“প্রতিদিনই অনেক মানুষ ভিড় করছেন টিকা নিতে। আবার অনেকেই টিকা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩৫০ জনকে টিকা দিচ্ছি।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ জানান, নগরীর বাসিন্দার তুলনায় টিকা খুবই অল্প থাকায় প্রত্যাশার চাপ বেড়ে চলছে।
তিনি বলেন, “একটা ওয়ার্ডে এক থেকে দেড় লাখ মানুষের বসবাস। আমি যদি ২৫ বছরের ওপর ধরি, তাহলে কম করে হলেও ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। অথচ গণটিকাদান কাম্পেইনের ছয়দিনে আমরা টিকা দিতে পারব মাত্র দুই হাজার ১০০ জনকে।
“বাকিদের তো আমরা দিতে পারব না। মানুষের তো প্রত্যাশা বেড়েছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জনগণের প্রত্যাশা থাকলেও গণটিকাদান কর্মসূচি আবার শুরু করা হবে কিনা তা নির্ভর করছে টিকার পর্যাপ্ততার ওপর।
অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেন, “আসলে আমরা আবার ক্যাম্পেইন করতে পারব কিনা তা নির্ভর করছে, টিকার অ্যাভেইলিবিলিটির উপর। পর্যাপ্ত টিকা থাকলে হয়ত আবার ক্যাম্পেইন হবে।”
টিকার খতিয়ান
দেশে এখন চারটি কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মর্ডানা ও সিনোফার্মের টিকা।
বুধবার পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে এসব কোম্পানির মোট দুই কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা এসেছে এ পর্যন্ত।
এর মধ্যে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক কোটি ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৩০০, মডার্নার ৫৫ লাখ, সিনোফার্মের ১ কোটি ১৫ লাখ ডোজ এবং ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা।
মঙ্গলবার পর্যন্ত (১০ অগাস্ট) এক কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। আর মজুদ আছে ৫৯ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ ডোজ।
এরই মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়ার মতো অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্নার টিকা আর নেই। ফলে এখন ভরসা সিনোফার্মের টিকা। বিপুল চাহিদার বিপরীতে সে টিকার মজুদও কম।
এ পর্যন্ত সিনোফার্মের ৯৮ লাখ ডোজের মধ্যে থেকে ৬৮ লাখ প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন আরও দুই লাখের বেশি মানুষ।
তাই এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দিতেও আরও টিকা আসার অপেক্ষা করতে হবে সরকারকে। যদিও সবমিলিয়ে সাড়ে সাত কোটি সিনোফার্ম টিকা কেনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ১৪ অগাস্টের মধ্যে আরও ৫৪ লাখ টিকা দেশে আসবে।
কোভিড-১৯ টিকা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় ডোজ হাতে রেখেই টিকা দেওয়া হচ্ছে।”
মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকাতে দেশের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
টাস্কফোর্স বলছে, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিতে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডোজ টিকা লাগবে। আর ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে লাগবে প্রায় ২০ কোটি ডোজ টিকা।
বাংলাদেশ এখন যে হারে টিকা দিচ্ছে, তাতে এই বছর নাগাদ ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে বলে টাস্কফোর্সের অনুমান।