হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় ৪৭ বছর বয়সী বিপুল শাহকে স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছিল, যেমনটা অনেকের ক্ষেত্রেই করা হয়।
স্টেরয়েড কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন করোনাভাইরাসকে ঠেকাতে সর্বশক্তি ব্যবহার করে, তখন শরীরেরও কিছু ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি কমাতে অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক হয় স্টেরয়েড।
কিন্তু স্টেরয়েড দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দমিয়ে রাখে, যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের নেই, সবার রক্তেই চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
বিপুল বলেন, “আমি অনেককে চিনি, যারা কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর এখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খেয়ে চলেছেন।”
ভারতে প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যা চীনের পর বিশ্বে সর্বোচ্চ। চীনে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ কোটি ৬০ লাখ।
অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিনের সহায়তায় মানবদেহের কোষ রক্ত থেকে গ্লুকোজ নেয়, যা শক্তি তৈরির জন্য ব্যবহার হয়। কিন্তু অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে, তাহলে কোষ আর সেই গ্লুকোজ নিতে পারে না, ফলে রক্তে চিনি বা শর্করার আধিক্য তৈরি হয়। এ জটিলতাকে বলে ডায়াবেটিস।
দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অশনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে ত্বকের সমস্যা, চুল পড়ে যাওয়া কিংবা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি হতে পারে।
ডায়াবেটিস ওইসব রোগের একটি, যা করো দেহে বাসা বাঁধলে এবং তিনি কোভিডে আক্রান্ত হলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ও হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগও এ ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।
এখন চিকিৎসকদের আশঙ্কা, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের একটি বড় অংশ নতুন করে পুরোপুরি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ভারতে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বে সর্বোচ্চ।
মুম্বাইভিত্তিক ডায়াবেটোলজিস্ট ড. রাহুল বকশি বিবিসিকে বলেন, “দুশ্চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, মহামারী পার হওয়ার পর ভারতে ডায়াবেটিসের একটি সুনামি দেখা দিতে পারে।”
তিনি জানান, তার কাছে যারা এখন চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের ৮ থেকে ১০ শতাংশের আগে ডায়াবেটিসের কোনো ইতিহাস ছিল না। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার পর এখন তাদের মাসের পর মাস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খেতে হচ্ছে।
চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েডই এই কোভিড পরবর্তী ডায়াবেটিসের মূল কারণ, নাকি এক্ষেত্রে কোভিডেরও সরাসরি কোনো ভূমিকা আছে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে একটি ইংগিত মিলেছে। মিউকরমাইকোসিস বা প্রাণঘাতি ‘কালো ছত্রাক’ রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ভারতীয় চিকিৎসকরা এই যোগসূত্র খুঁজে পান।
ভারতে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ এই ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে সংক্রমণের শিকার হন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১২৭ জন রোগীর মধ্যে ১৩ জনের, অর্থাৎ ১০ শতাংশের দেহে নতুন করে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, যাদের আগে এ রোগ ছিল না। এই রোগীদের বয়সের গড় ৩৬ বছর। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনকে কোভিড চিকিৎসার সময় কোনো ধরনের স্টেরয়েড বা বাড়তি অক্সিজেন দিতে হয়নি।
অথচ এসব রোগীর রক্তে এখন উচ্চ পরিমাণে শুগার পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে গবেষক দলের সদস্য ড. অক্ষয় নায়ার বলেন, “এটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, সামনের বছরগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে।”
দিল্লি ও চেন্নাইয়ের দুটি হাসপাতালে ৫৫৫ জন রোগীর ওপর পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর যারা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তাদের ব্লাড শুগারের মাত্রা, যাদের ডায়াবেটিসের আগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের চেয়ে বেশি।
গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ডায়াবেটোলজিস্ট ডা. অনূপ মিশ্র বলেন, কোভিড এবং ডায়াবেটিসের মধ্যে যে যোগসূত্রের প্রমাণ এখন আসছে, তা যথেষ্টই জটিল।
তিনি বলেন, কোভিড থেকে সেরে ওঠা নতুন যাদের মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে, তাদের ক্ষেত্রে মূলত হিমোগ্লোবিনের এওয়ানসির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পরীক্ষায় রক্তে চিনির মাত্রার তিন মাসের গড় একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এখন, এটা হতে পারে যে, এসব রোগীর আগেই ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু পরীক্ষা না করায় তা ধরা পড়েনি। আবার এমনও হতে পারে যে তাদের কোভিড চিকিৎসার সময় স্টেরয়েড দেওয়ার পর রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেছে এবং এখন তা স্বাভাবিক মাত্রায় নামছে না।
অনূপ মিশ্র বলেন, “আমাদের ধারণা হল, এই রোগীরা মুটিয়ে যাওয়া বা পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাসের কারণে আগে থেকেই ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে ছিল।”
আর সংখ্যায় খুব কম হলেও কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস মারাত্মক আকারে দেখা দিচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে কোভিডে অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে ডা. মিশ্রর ধারণা।
ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক গাই রুটারের মতে, করোনাভাইরাস দেহের যেসব অঙ্গকে আক্রমণ করে, তার একটি হল অগ্ন্যাশয়। যাদের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হওয়াও বিঘ্নিত হতে পারে। ফলে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে।
তবে কোভিড থেকে সেরে ওঠা এ ধরনের রোগীদের ডায়াবেটিস স্থায়ী হয়ে যাবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয় গবেষকদের কাছে।
তবে মহামারী কেটে গেলেও ভারতকে একটি বড় সংখ্যক ডায়াবেটিস রোগীর ভার সামলাতে হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।
ভাইরাসের প্রকোপ আর লকডাউনের কারণে ভারতে অনেকেই দীর্ঘদিন বাসা থেকে কাজ করেছেন। অনলাইনে অর্ডার করে বাইরের খাবার খেয়েছেন। তাদের শরীরিক পরিশ্রমও সেভাবে হয়নি। অনেকে আবার উদ্বেগ বা হতাশায় ভুগেছেন নানা কারণে।
ডা. মিশ্র বলেন, “এ ধরনের ব্যক্তিদের অনেকেই হয়ত সামনে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা আমাকে সত্যিই উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”