লকডাউন শেষে স্বাস্থ্যবিধি ও টিকায় জোর বিশেষজ্ঞদের

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ঈদের পর লকডাউন শুরুর দিন ১৬৬ জন কোভিড-১৯ মৃত্যুর খবর এসেছিল; আর লকডাউনের শেষ দিন মৃত্যুর সংখ্যা ২৬৪, যা দিনের হিসাবে সর্বাধিক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2021, 07:43 PM
Updated : 11 August 2021, 02:44 AM

গত ২৩ জুলাই লকডাউন শুরুর দিনে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত রোগীর হার ছিল ৩১ শতাংশের উপরে, বুধবার তা কমে ২৩ শতাংশে দাঁড়ালেও প্রতিদিন এখনও গড়ে ১০ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে মহামারীর নাজুক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলেও বুধবার থেকে প্রায় সব বিধি-নিষেধ উঠে যাচ্ছে, ফলে দুই-একটি ক্ষেত্র বাদে আবার চলাচল শুরু হবে।

১৮ দিন সব বন্ধ রাখার পর লকডাউন অব্যাহত রাখা অর্থনীতিসহ মানুষের জীবন-জীবিকার দৃষ্টিকোণ কঠিন বলে মেনে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরাও।

তবে ঘরের বাইরে মানুষের চলাচল যে সংক্রমণ আবার বাড়িয়ে তুলবে সেই শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে। কারণ ঈদের সময় নয় দিন লকডাউন শিথিলের পরই সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে রেকর্ডের পর রেকর্ড দেখেছে বাংলাদেশ।

দ্বিমুখী সঙ্কটের এই পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা টিকাদান বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার উপরই সমাধান খুঁজছেন।

লকডাউনের শেষ দিন মঙ্গলবার ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের সড়কে ব্যক্তিগত বাহনের সারি দেখে বিধি-নিষেধ বোঝা যায়নি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

লকডাউন তুলে দেওয়ায় ‘কিছুটা ঝুঁকি বাড়বে’ মানলেও অন্য কোনো উপায়ও দেখছেন না বলে জানান কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লকডাউন তো সরকারের পক্ষে আজীবন দেওয়া সম্ভব না।”

এখন কী করতে হবে- প্রশ্নে স্বাস্থ্যবিধি মানার ‘অনেক জোর’ দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

“লকডাউনের কারণে অনেক মানুষ ঘরে ছিল, বাইরে বের হয়নি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কিছু হলেও মানা গেছে। কিন্তু এখন তো আমরা সবাই বের হব। আমাদের মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব মানার উপর খুবই জোর দিতে হবে।”

এক্ষেত্রে প্রশাসনের তৎপরতার উপর জোর দিয়ে ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, “প্রশাসনকে তো এখন গাড়ি চেক করা, মানুষ কেন বেরিয়েছে- সেই কাজগুলো করতে হবে না। তাই মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না, তাদেরকে সেই জায়গাগুলোতে তৎপর হতে হবে। সেটা দোকানপাটে হোক, রাস্তাঘাটে হোক, গণপরিবহনে হোক।”

লকডাউনে পথে নামারা পড়েছিল বিজিবির জেরার মুখে। ফাইল ছবি

বিধিনিষেধ না থাকলেও তিনটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

প্রথমত, মানুষকে সচেতন করতে তৎপরতা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানো ও সহজলভ্য করা; তৃতীয়ত টিকাদানে গতি বাড়ানো।

ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, “টেস্ট করে যাদের সংক্রমণ ধরা পড়বে, তাদের আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। নমুনার সংখ্যা বাড়ার ফলেই অনেক রোগী চিহ্নিত করা গেছে। টেস্ট না করলে তো এরা ঘুরে বেড়াত। সংক্রমণ বেড়ে যেত।”

“টিকার সরবরাহ যেন বন্ধ না হয়, সেটি সরকারের তরফ থেকে নিশ্চিত করে জনগণকে আস্তে আস্তে টিকার আওতায় আনতে হবে।”

লকডাউন শেষে বুধবার থেকে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে মঙ্গলবার বিকেলে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে বেশিরভাগ ফেরিই আসে গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, এই লকডাউন কার্যকর হয়েছে কি না, তা অগাস্টের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ কমে যাবে। আর এখন সব কিছু খুলে দেওয়ার প্রভাব আরও দুই সপ্তাহ পরে বোঝা যাবে।

লকডাউন তোলায় রোগী বাড়ার শঙ্কা থেকে গেলেও সরকারেরও কিছু করার ছিল না বলে মনে করেন তিনি।

“এখন সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তাতে খোলার তো কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এতদিন রাখতে পারছে না। সাধারণ মানুষকে সাপোর্ট করার মতো রাষ্ট্রকাঠামো, অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো আমাদের নেই। ওয়েলফেয়ার স্টেট হলে হয়ত আমরা সেটা আশা করতে পারতাম।”

“আমাদের সমাজে অনেক বৈষম্য রয়েছে। সমাজের নিচু শ্রেণির মধ্যে অভিঘাতটা সবচাইতে বেশি। তাদের পক্ষে লকডাউন মানা কিছুতেই সম্ভব না। ঘরে তাদের সাতদিনের খাবার থাকে না। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হলেও প্রান্তিক মানুষদের ঘরে দুই সপ্তাহের খাবার থাকে না। এসব কারণেই সরকার খুলে দিয়েছে,” বলেন ছাত্র জীবন থেকেই বাম আন্দোলনে যুক্ত এই গবেষক।

এখন স্বাস্থ্যবিধি পালনে জোর দিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, “আমাদের যথাসম্ভব মাস্ক তো পরতেই হবে। তার চেয়ে বেশি জরুরি বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, জনাসমাগম হয় যেখানে, সেসব স্থান মনিটরিং করা। না হলে সংক্রমণ কমানো যাবে না।”

শনাক্ত রোগীর চিকিৎসা সহায়তার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও উদ্বুদ্ধ করা এবং সবাইকে টিকার আওতায় আনতে বলছেন এই বিশেষজ্ঞ।

ঢাকার কর্মচারী হাসপাতালে কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রে মঙ্গলবার সকাল থেকে ছিল এমন ভিড়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“স্বাস্থ্যবিধি মানাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্টরা প্রচারণা চালাবে। বিশেষ করে টিকা কেন্দ্র এ প্রচারণার কেন্দ্র হতে পারে। তাহলে পুরো দেশ বন্ধ করতে হচ্ছে না, জনগণ সচেতন হবে।”

এদিকে টানা লকডাউন চললেও সংক্রমণ না কমায় তাকে ততটা কার্যকর বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।

তিনি বলেন, “দিনের পর দিন তো লকডাউন দেওয়া যায় না। জীবন-জীবিকার তাগিদেই সবকিছু খুলে দিতে হল। বরং জনগণ যেন কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।”

সেজন্য মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “জনগণকে মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার দুটা রাস্তা- স্বাস্থ্যবিধি মানা ও টিকা নেওয়া। এই দুই বিষয়ে জোর দিলে লকডাউনের চেয়েও বেশি উপকার হবে। তাহলেই সংক্রমণ কমানো যাবে।”