কোভিড গণটিকা: উৎসবের আবহে বিশৃঙ্খলাও ছিল

গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হলে মানুষের উৎসাহ যেমন দেখা গিয়েছিল, মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামে-গঞ্জেও সংক্রমণ ঘটানোর পর এবার সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিতে তার চেয়ে বেশি আগ্রহই দেখা গেল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2021, 06:52 PM
Updated : 7 August 2021, 06:54 PM

শনিবার ঢাকায় ও সারাদেশের বিভিন্ন টিকাকেন্দ্র ঘুরে ভিড় দেখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ টিকা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর মানুষ টিকা নিতে এসেছে। আমরা মনে করি, এই গণটিকাদান কর্মসূচি মানুষের মধ্যে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনার তৈরি করবে।”

এই কর্মসূচিকে টিকাদানের ‘উৎসব’ বলেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। আবহ তেমন হলেও কিছু বিশৃঙ্খলাও দেখা গেল।

ভিড়ের কারণে টিকাদান কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো সুযোগই ছিল না। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি সামলাতে বারবারে বাঁশি ফুঁকতে হয়েছে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের। ভিড় সামলাতে গলদঘর্ম হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকেরাও।

গণটিকাদান শুরুর দিন শনিবার শেরেবাংলা নগরে রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে টিকা গ্রহীতাদের ভিড়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কোভিড-১৯ মহামারীর এই সময়ে প্রতিরোধের বর্ম হিসেবে টিকাকেই আশ্রয় করছে বিশ্ববাসী।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে গণটিকাদান শুরু হলেও তা গতি হারায় মাঝে টিকা সঙ্কটের কারণ। আর এর মধ্যে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলেছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও ঘরে ঘরে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটছে।

এই পরিস্থিতিতে টিকা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে থাকায় গ্রামেও টিকাদান শুরু হল শনিবার। বড় পরিসরে বিরাট জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে পরীক্ষামূলক ধাপ হিসেবে এবার টিকা দেওয়া হচ্ছে।

এই ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দিতে সারাদেশে ১৫ হাজারের বেশি টিকা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

এই কর্মসূচি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় চলবে ৯ অগাস্ট পর্যন্ত। এছাড়া প্রথমদিন বাদ পড়া ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ের ওয়ার্ডে টিকা দেওয়া হবে ৮ ও ৯ অগাস্ট।

৮ ও ৯ অগাস্ট টিকা দেওয়া হবে দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। আর ১০ থেকে ১২ অগাস্ট ৫৫ বছরের বেশি বয়সী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকা কর্মসূচি চলবে।

ডা. শামসুল হক বলেন, “আজকে আমরা টিকা কর্মসূচি শুরু করলাম। যদি কোনো এলাকায় আজকে শুরু করা না যায়, তাহলে আমরা সেখানে কালকে করব। মানুষকে বাদ দেওয়া হবে না। ছয়দিনব্যাপী এই কর্মসূচি সারাদেশের আনাচে-কানাচে আমরা ছড়িয়ে দেব।”

গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর দিন শনিবার সকালে তেজকুনিপাড়ায় তেজগাঁও মডেল হাই স্কুলে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে মানুষের ভিড়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সরেজমিন ঢাকা

দুপুর ১টার দিকে আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায় পুরুষদের লাইনে চলছে ধাক্কাধাক্কি। আর তা থামাতে পুলিশ-আনসার সদস্যরা বাঁশি ফুঁকিয়ে চলছেন।

তখনও অপেক্ষমান ৪০ জন নারী। সেখানে এসে একজন আনসার সদস্য ঘোষণা দিলেন আর মাত্র ১৩ জনকে টিকা দেওয়া হবে। এরপরই শুরু হয়ে যায় হইচই, হট্টগোল। ইয়াসমিন নামে একজন নারী বলেন, বেলা ১১টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দুই ঘণ্টা দাঁড়ানোর পর এখন শুনছেন যে আর মাত্র ১৩ জনকে টিকা দেওয়া যাবে।

কেন্দ্রের একজন স্বেচ্ছাসেবক জানালেন, সাড়ে তিনশ জনকে টিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পঞ্চাশটি টিকা কম আসায় এই বিপত্তি হয়েছে।

চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর টিকা পান বলে জানান দিনমজুর কবিরুল ইসলাম।

গৃহকর্মী জুলেখা বেগমকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সাড়ে তিন ঘণ্টা। অপেক্ষার পরও টিকা পেয়ে খুশি মধ্যবয়সী এই নারী বলেন, “আমাগো কেউ পাত্তা দেয় না। তাও যে লাইনে খাড়ায়া টিকা পাইছি।”

ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনাভাইরাসের গণ টিকাদান শুরুর দিন শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন অশীতিপর দুই বৃদ্ধা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

স্থানীয় যুবলীগ ও তরুণদের দল টিকা বুথের সামনে মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে কার্ড লিখে দেন। সেই কার্ড নিয়ে আবার তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে হয়।

মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকা কেন্দ্রে দিনভরই ছিল ব্যাপক ভিড়।

এই কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা আমির হোসেন রিকু বলেন, “প্রচুর অব্যবস্থাপনা। চেয়ার পেতে মানুষকে বসিয়ে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ।

“সবচেয়ে বড় বিষয় তারা যে সাড়ে তিনশ মানুষকে টিকা দেবে, মাথা গুনে লোক ঢুকিয়ে ফটকটা বন্ধ করে দিলে অন্তত কিছুটা বিশৃঙ্খলা এড়ানো যেত। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে দিন শেষে অনেক মানুষকেই টিকা ছাড়া ফিরতে হয়েছে।”

ঢাকার আরও বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে টিকা না নিয়েই অনেককে ফিরতে হয়েছে।

যশোরের শার্শার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের বাগআঁচড়া হাইস্কুলের টিকাদান কেন্দ্রে মানুষের অপেক্ষা।

ঢাকার বাইরে

উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ টিকা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিরা।

চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন এএসএম মারুফ হাসান বলেন, “জেলার ৫৯টি কেন্দ্রের ১১৯টি বুথ থেকে প্রথম দিন টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিন ২৩ হাজার ৯০০ জনকে টিকা দেওয়া যাবে এমন প্রস্তুতি আমাদের ছিল।

“প্রতি বুথ থেকে ২০০ জনকে আমরা টিকা দিয়েছি। মানুষ নিজ উদ্যোগেই এসে টিকা নিয়েছে।”

টাঙ্গাইলে সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে টিকা নিতে আগ্রহী বয়স্ক নারী-পুরুষের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। হাসপাতালগুলোয় টিকা কার্যক্রম শুরু হলে গ্রামের মানুষের টিকা নিতে আগ্রহ অনেকটাই ছিল না। তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছিল। শনিবার মানুষের মধ্যে ভীতি দেখা যায়নি।

যশোরের শার্শার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের বাগআঁচড়া হাইস্কুলের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, “ছোটবেলায় অনেক টিকা নিছি। তখন তো টিকা নিলি অনেক কষ্ট হত-ঘা হয়ে যেত, ৮/১০ দিন ভুগতি হত। আজকে টিকা নিলাম তা তো কিছুই বুঝতি পারলাম না।”

টিকা নিয়ে পিঁপড়াগাছির আব্দুর রহমান (৩০) বলেন, “করোনার টিকা নিয়ে আমাদের ভুলভাল বুঝিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন বুঝিছি ওসব গুজব। টিকা দিয়ে খুব ভালো লাগছে।”

চট্টগ্রাম নগরীতে বৃষ্টির মধ্যে কোভিড-১৯ টিকা নিতে ভিড়। ছবি: সুমন বাবু

রাজবাড়ী-ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজনকে দুইবার টিকা

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের পাটকিয়াবাড়ী দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে এক গৃহবধূর শরীরে এক সঙ্গে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়। ইসমত আরা (৩১) নামে ওই নারীকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

ইসমত আরার স্বামী নাহিদুল হক স্বপন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, সকালে তার স্ত্রীর বাম হাতে টিকা দেন স্বাস্থ্যকর্মী। টিকা নেওয়ার স্থান তিনি অন্য হাতে চাপ দিয়ে ধরেছিলেন। তখন ওই হাতে আরেক স্বাস্থ্যকর্মী এসে টিকা পুশ করে দেয়।

ওই নারীকে দুই ডোজ টিকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে সিভিল সার্জন ডা. মো. ইব্রাহিম টিটন সাংবাদিকদের বলেন, “এটা আসলে ভুলবশত অথবা অসতর্কতা কারণে হতে পারে।”

তবে ৩৮ বছর বয়সী ওই নারী সুস্থ আছেন বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

তেজকুনিপাড়ায় তেজগাঁও মডেল হাইস্কুল কেন্দ্রে শনিবার টিকা নেওয়ার পর নিজের টিকা কার্ড হাতে একজন। গণটিকাদান কর্মসূচিতে হাতে লেখা বিশেষ এ কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এক নারী দুই বার টিকা নিয়ে ফেলেন। তবে ৩৮ বছর বয়সী ওই নারী সুস্থ আছেন বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

ওই নারীর স্বামী সাংবাদিকদের বলেন, টিকা কার্ডের জন্য তার স্ত্রী টিকাদানকর্মীর কাছে গেলে তার স্ত্রী দ্বিতীয়বার টিকা নিয়ে ফেলেন।

বিষয়টি জানাজানি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোমান মিয়া ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে ওই টিকা কেন্দ্রে যান।

গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর দিন শনিবার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি কেন্দ্রে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে আসা একজনের ফরম পূরণ করছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নিবন্ধনের গতি বেড়েছে

টিকা নিতে সরকারের তৈরি সুরক্ষা অ্যাপে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিট পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ নিবন্ধন করছেন।

এই অ্যাপের দেখভালকারী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত প্রতি মিনিটে সাড়ে তিন হাজার, এবং প্রতি ঘণ্টায় দেড় থেকে দুই লাখ নিবন্ধন হচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি।”

মাসুম বলেন, “আগে টিকা নিবন্ধনের সংখ্যা তেমন বেশি ছিল না। নিবন্ধনের সংখ্যাটা এক কোটি ছাড়িয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু গত ২৫ জুলাইয়ের কাছাকাছি সময় থেকে টিকা নেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণেই বোধহয় তখন থেকে নিবন্ধনের সংখ্যাটাও দ্রুত বেড়েছে।”