সরেজমিন কোভিড হাসপাতাল: শ্বাসকষ্টের রোগী আসছেন একের পর এক

শুক্রবার দুপুর ১টা। রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগী নিয়ে ঢুকল একটি অ্যাম্বুলেন্স।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2021, 07:23 PM
Updated : 31 July 2021, 08:48 PM

গাড়িটি থামতেই দরজা খুলে দুজন দ্রুত বের হয়ে ভর্তির তথ্য জানতে ছুটলেন। একজন গাড়িতেই রয়ে গেলেন বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। আর নড়াচড়া করছেন না রোগী।

কাছে গিয়ে জানা গেল, সদ্য মৃত ব্যক্তির নাম সুজাত আলী (৮৫)। বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ঈদের আগের দিন থেকে জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। পরীক্ষা করিয়ে তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।

এরপর ছেলেরা তাকে লাকসামের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করান। অক্সিজেন দেওয়া শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হতে থাকলে শুক্রবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে বলেন চিকিৎসকেরা।

শনিবার সকালে ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে সুজাত আলীকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন দুই ছেলে মাহাবুব আলম ও জাহাঙ্গীর আলম এবং জামাতা আব্দুল হান্নান। বাবাকে নিয়ে তারা দুপুর ১টার দিকে সিটি করপোরেশনের এই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে পৌঁছান।

গাড়ি হাসপাতালের সামনে থামার পর ভর্তির তথ্য জানতে ভেতরে যান জাহাঙ্গীর ও হান্নান। গাড়ির ভেতরে বাবার সঙ্গে ছিলেন মাহাবুব আলম। এর মধ্যেই গাড়ির ভেতরে ছটফট শুরু করেন বাবা সুজাত আলী।

মাহাবুব আলম বারবার ডাকছিলেন, ‘আব্বা, ও আব্বা’। বাবাকে পানিও খাওয়ান তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্থির হয়ে যান সুজাত আলী। গাড়ির ভেতরে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না মাহাবুব।

একবার ভাইকে ডাকেন, আরেকবার বাবাকে জাগানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। গাড়ি চালকের ডাকে দৌড়ে এসে গাড়ির ভেতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছোট ভাই জাহাঙ্গীরও।

কান্না কমলে জাহাঙ্গীর বলেন, “সবাই আগলে রেখেছিলাম, বাবা ভালোই ছিলেন। ঈদের আগে হঠাৎ জ্বর। পরীক্ষা করে কোভিড ধরা পড়ল। এরপরই অক্সিজেন দিতে হল। ঢাকায় আনলাম কিন্তু বাঁচাতে পারলাম কই।“

“হাসপাতালে ঢোকার মুখেও তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন। হাত-পা নাড়াচ্ছিলেন”, বলে আবার কাঁদতে শুরু করেন জাহাঙ্গীর।

আইসিইউ পেতে তিনদিন

ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালের সামনে একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন সিরাজগঞ্জের ইদ্রিস আলী খান (৬৫)। তিনিও ঈদের আগে কোভিডে আক্রান্ত হন।

তার ছেলে মেহেদি হাসান বলেন, “সিরাজগঞ্জের ডাক্তারেরা বলে দিলেন বাবাকে বাঁচাতে হাই ফ্লো অক্সিজেন প্রয়োজন। তাই তিন দিন আগে বাবাকে নিয়ে ঢাকায় এলাম।“

অনেক ঘুরেও কোনো সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ পাননি। পরে কলেজগেটের কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু খরচ হচ্ছিল প্রচুর, দিনে লাখ টাকার মত।

তিনদিন চেষ্টা করে তারা ডিএনসিসি হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেড পেতে সমর্থ হন। কিন্তু ইদ্রিস আলীর অবস্থা এতোটাই খারাপ যে সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে তাকে আনা যাচ্ছিল না। পরে সাত হাজার টাকায় আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে কলেজগেট থেকে মহাখালী আসেন।

এই হাসপাতালে আসা অনেক কোভিড রোগীর চিত্র কাছাকাছিই। সবাই শ্বাসকষ্ঠ নিয়েই ছুটে এসেছেন এখানে।

যেমনটি ঢাকার দোহার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে আবুল হোসেন এসেছেন মা মানিককি বেগমকে নিয়ে। তারও শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পর চিকিৎসকরা ঢাকায় নিতে বলেন।

ডিএনসিসির এই হাসপাতালের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর মায়ের জন্য শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেন আবুল হোসেন।

ঢাকার ডেমরা থেকে সোনা মিয়াকে (৬৫) একটি অটোরিক্সায় করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন ছেলেরা। যখন তিনি হাসপাতালে পৌঁছান তখন শ্বাসকষ্টে রীতিমতো গোঙাচ্ছিলেন।

তাকে অটোরিক্সা থেকে নামিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নেওয়ার জন্য ট্রলির অপেক্ষা পর্যন্ত করতে দিতে চাইলেন না হাসপাতালের কর্মীরা। পাঁজাকোলা করে ধরে তাকে হাসপাতালের ‘ট্রায়াজ’ কক্ষে নেওয়া হল।

মুন্সীগঞ্জের সিপাইপাড়ার গৃহবধূ ঝুমা আক্তার (২৩) দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন। ঢাকার কিডনি ইনস্টিটিউটে ২২ দিন ধরে ভর্তি ছিলেন।

গত দুইদিন ধরে ঝুমার তীব্র কাশি ও শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কিডনি ইনস্টিটিউট থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোভিড হাসপাতালে।

ঝুমার বড়বোন ঝিমি আক্তার বলেন, “কী যে হইব, কতদিন ধইরা কিডনির সমস্যায় ভুগতাছে। ওর স্বামী থাকে বিদেশ। চাইর বছরের বাচ্চা আছে।”

বাড্ডার সালমা বেগম স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরীক্ষার পর দেখা যায় তিনি কোভিডেও আক্রান্ত। এরপর চিকিৎসকরা তাকে কোভিড হাসপাতালে পাঠান। কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পর শুক্রবার দুপুরে তাকে ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: