লকডাউন তুলে নেওয়ায় ‘ঝুঁকি বাড়ল’

দেশে যখন করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, তখন সব বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ায় সংক্রমণের বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হল বলে মনে করছেন কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2021, 07:33 PM
Updated : 13 July 2021, 07:43 PM

শুরু থেকে মহামারী পরিস্থিতিতে চোখ রেখে তা প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়ে আসা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, এই মুহূর্তে সব বিধি-নিষেধ তুলে ফেলায় মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে।

তবে জীবন ও জীবিকার স্বার্থে এবং অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে লকডাউন শিথিলের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।

গত বছর কোভিড মহামারী শুরুর পর ভারতে উদ্ভূত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্থানীয় সংক্রমণে এখনই সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থা পার করছে দেশ।

এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশে গত ১ জুলাই থেকে দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করে সরকার।

এরপরও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়ায় অচিরেই পরিস্থিতি আরও করুণ হয়ে ওঠার শঙ্কা কয়েকদিন আগেই প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এর মধ্যেই কোরবানির ঈদের সময় নয় দিনের জন্য সব বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার।

গত কয়েকটি ঈদে মানুষের যাতায়াত বাড়ায় সংক্রমণও বাড়তে দেখা গিয়েছিল। এবার তার সঙ্গে কোরবানির পশুর হাট সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা।

করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউন’ শুরুর আগে সীমিত বিধিনিষেধ শুরুর দিন সোমবার শপিংমল বন্ধ থাকায় জনশূন্য ছিল নিউ মার্কেট ফুটব্রিজ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লকডাউনটা এখন এভাবে উঠিয়ে দিলে সবাই তো আবারও রাস্তাঘাটে বেরুবে, অফিস-আদালতে যাবে, গণপরিবহনে চড়বে, বাজারে যাবে।

“সব মিলিয়ে তো যত বেশি মানুষের মেলামেশা হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে না, সংক্রমণ তত বেশি বেড়ে যাবে। সেজন্য ঝুঁকিটা তো থেকেই যাচ্ছে।”

কোভিড পরামর্শক কমিটি চলমান লকডাউন আরও দুই সপ্তাহ বাড়ানোর পক্ষপাতি ছিল; কিন্তু ঘটেছে উল্টো।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি শহীদুল্লাহ বলেন, “জাতীয় পরামর্শক কমিটি মনে করে, এই বিধি-নিষেধ আরও দুই সপ্তাহ থাকলে কিছুটা ফলাফল আমরা পেতাম। কারণ এই দুই সপ্তাহ যেভাবে চলেছে, তার আগে যেভাবে সংক্রমণটা ছড়িয়ে গেছে, যার ফলে এটা থামছে না।

“এই সংক্রমণটা নিঃসন্দেহে নামবে। কিন্তু সেই নামাটা অনেক বেশি নামত, যদি আমরা বিধি-নিষেধ আরও দুই সপ্তাহ কার্যকর করতাম।”

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে যশোরে হাসপাতালে শয্যার অভাবে বাইরে রোগী।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন করেন, জনস্বাস্থ্য ও রোগতাত্ত্বিক দিক থেকে এখন লকডাউন শিথিল করার সময় না।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার হয়ত আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় নানা কার্যকলাপের কারণে লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে।

“কিন্তু নয় দিন ধরে সব বিধি-নিষেধ তুলে ফেলা, সেটার ফলে একটা ভুল বার্তা যাবে।”

গত রোজার ঈদে ফেরিতে ছিল এমন গাদাগাদি; পরে সংক্রমণও বেড়েছিল। ফাইল ছবি

ডা. শহীদুল্লাহ ও ডা. মুশতাকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লকডাউনই একমাত্র সমাধান না। এটা তো দিনের পর দিন চালানো যায় না। যারা দিন আনে দিন খায়, লকডাউনে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তারা তো চলতে পারছে না, অসহায় হয়ে গেছে। জীবন বাঁচানোর জন্য জীবিকারও দরকার।

“সামনে তো ঈদ। আবার কোরবানির ব্যাপারও রয়েছে। অনেকে সারা বছর লালন-পালন করে একটা পশু বড় করে, সেটাকে কুরবানির ঈদে ‍বিক্রি করার জন্য। বিক্রির টাকা দিয়ে সে সারা বছর চলে। অনেক মার্কেট-দোকান বন্ধ। তাদের তো চলতে হবে।”

মোহাম্মদ সোহাগ ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল গত ২০ বছর ধরে পান, সিগারেট ও পানি বিক্রি করছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর আগে প্রতিদিন হাজার দুয়েক টাকার বিক্রি হত, কিন্তু লকডাউনের কারণে বাস বন্ধ বলে তার বেচা-বিক্রিও তলানিতে নেমেছে। সোহাগ জানান, এখন দিনে দুইশ থেকে তিনশ টাকা বিক্রি হয় তার, যা দিয়ে সংসার চলে না। এমন দিন আগে কখনও আসেনি তার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এই অধ্যাপক বলেন, “শুধু সরকারি কর্মচারীরা ঘরে বসে আরামে আছে, আর বেতন পাচ্ছে। কিন্তু প্রাইভেটে যারা আছে, তাদের অনেকের চাকরি নাই। অনেকে বেকার, অনেকে বেতন পাচ্ছে না। তাদেরও তো চলতে হবে। আমার মনে হয়, এইসব চিন্তা করে লকডাউনটা শিথিল করা হয়েছে। এটা ঠিকই আছে।”

এখন করণীয় কী?

বিধিনিষেধ উঠিয়ে নিলেও এই সময়ে জনগণকে সব অবস্থায় সতর্ক থাকতে, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলেছে সরকার।

ঈদে স্বাস্থ্যবিধিতে বাড়তি নজর দেওয়ার কথা বলছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহও।

“লকডাউন শিথিল হলেও সরকারের উচিত হবে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে বাধ্য করা। জনগণ যেন খামখেয়ালি না করে নিজ দায়িত্বে স্বাস্থ্যবিধি মানে। সবকিছুই সুন্দরভাবে চলুক, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন হয়। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।”

জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, “যারা যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ করেন। অযথা যাওয়া-আসা করবেন না। কোরবানির হাটে সাবান, পানি, মাস্ক- এসবের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ক্রেতারা যেন বেশি ঘোরাঘুরি করে গরু না কিনেন। প্রয়োজনে অনলাইন থেকে কিনতে পারেন। গরু জবাইয়ের সময়ও যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে।”

লকডাউন বাস্তবায়নে ঢাকার সড়কে তৎপর ছিল ট্রাফিক পুলিশ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গণপরিবহন, কোরবানির হাট, ঈদের জামাতসহ সব জায়গায় চলাচলের বিষয়ে সতর্ক করার তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, “এসব জায়গায় বয়স্ক মানুষ, জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ যেন না ঢোকেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যারা যাবেন অবশ্যই মাস্ক পরবেন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা যেন থাকে। ভিড় যেন না থাকে, সেটা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করবে।”

“জনগণকে সবসময় মনে করিয়ে দিতে হবে, আমরা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছি। সরকার বাধ্য হয়েই শিথিল করেছে,” সরকারের উদ্দেশে বলেন তিনি।

লকডাউন বাস্তবায়নে মাঠে ছিল সেনা সদস্যরাও। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

‘মন্দের ভালো’ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারকে কঠোর হতে বলেছেন জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ।

“সরকার যদি জীবিকার প্রয়োজনে খোলেও, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা দরকার। মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্বটা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সরকার কঠোর থাকলে মানুষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলবে না।”

ঈদের জন্য নয় দিন শিথিল করলেও এরপর ২৩ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত আবারও আগের বিধিনিষেধগুলো কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সরকার। অর্থাৎ মহামারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় লকডাউন আবার ফিরছে।