রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কীভাবে ফাঁকি দেয় ‘ডেল্টা’?

টিকা দেওয়ার পর যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন তাদের কীভাবে আক্রান্ত করছে, তার একটি উত্তর খুঁজে পেয়েছেন ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2021, 06:04 PM
Updated : 11 July 2021, 06:07 PM

তারা বলছেন, কিছু টিকা তৈরি হয়েছে ভাইরাসের নির্দিষ্ট কিছু অংশকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর জন্য। অর্থাৎ, ওই টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা করোনাভাইরাসের নির্দিষ্ট কিছু অংশকে চিনতে পারে এবং তার ভিত্তিতে আক্রমণ চালিয়ে ভাইরাসকে পরাস্ত করতে পারে। 

কিন্তু যেসব অ্যান্টিবডি ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো অংশকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়ম, তাদের ফাঁকি দিতে পারে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরন।

ফ্রান্সের বিজ্ঞানীদের এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি গত সপ্তাহে প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরনের তুলনায় ডেল্টার বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা কম হওয়ার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে এই গবেষণা থেকে।

ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া ডেল্টা ধরনটি মহামারীর প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া আলফা ধরনের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি এবং মূল করোনাভাইরাসের চেয়ে দ্বিগুণ সংক্রামক বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

পর্তুগাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মত যেসব দেশে টিকাদানের হার কম, সেখানে মহামারী ছড়িয়ে দেওয়ার মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে এই ডেল্টা ধরন।

যুক্তরাষ্ট্রেও এখন সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনটি। মহামারী শুরুর পর সেখানে সংক্রমণের হার সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে মহামারীর শুরুর পর্যায়ে এসেছে, যদিও এই সংখ্যা আবারও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে।

এর পেছনে টিকাদানের উচ্চহার একটি ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮ শতাংশ মানুষ পুরোপুরি টিকা পেয়েছেন এবং ৫৫ শতাংশ অন্তত এক ডোজ টিকা নিয়েছেন।

নেচারে প্রকাশিত নতুন গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, টিকার একটি ডোজ ডেল্টা ধরনটির বিরুদ্ধে খুব সামান্যই প্রতিরোধ গড়তে পারে।

আগের একটি গবেষণাতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অ্যান্টিবডির প্রতিরোধ ব্যবস্থা আংশিক ভেদ করতে পারে, যদিও তা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া বেটা ধরনটির চেয়ে কম মাত্রায়।

স্বাভাবিক সংক্রমণের পর দেহে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি এবং করোনাভাইরাসের টিকা থেকে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসের আলফা, বেটা ও ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর, তা ফ্রান্সের গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন। পাশাপাশি ভাইরাসের মূল ধরনটির সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে।

সেজন্য গবেষকেরা ১০৩ জন মানুষের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছেন, যারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এই দলের যারা টিকা নেননি তাদের রক্তে আলফার তুলনায় ডেল্টা ধরনটি অনেক কম সংবেদনশীল।

আবার টিকার একটি ডোজ দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সংবেদনশীলতা অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে, যা থেকে ধারণা মিলছে যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের যারা এখনও টিকা নেননি, ভাইরাসটির কিছু ধরন থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য তাদেরও টিকা নেওয়া দরকার।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার-বায়োএনটেকের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন এমন ৫৯ জনের নমুনাও পরীক্ষা করেছে এই গবেষক দল।

পরীক্ষাগারের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার একটি ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের রক্তের নমুনায় ডেল্টা ও বেটা ধরনটিকে ঠেকানোর মতো সামর্থ্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৫ শতাংশ।

দুই কোম্পানির টিকাতেই যে ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাদের মধ্যে তেমন বড় কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।

গবেষকরা বলছেন, ফাইজার বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার একটি ডোজ করোনাভাইরাসের বেটা ও ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে খুবই দুর্বল বা অকার্যকর।

ইসরায়েল ও ব্রিটেন থেকে পাওয়া তথ্যউপাত্তও তাদের এই ফলাফলকে সমর্থন করছে, যদিও এসব গবেষণা থেকে এটাও জানা গেছে যে টিকার একটি ডোজ ভাইরাসে সংক্রমণের পর হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুর মত ঘটনা কমাতে সক্ষম।

নতুন গবেষণাপত্রটি থেকে জানা গেছে, ওষুধ কোম্পানি- এলি লিলির উদ্ভাবিত মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি - ব্যামল্যানিভিম্যাবের বিরুদ্ধে ডেল্টা ধরনটির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারেনি। তবে অন্য তিনটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ওই ধরনটির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এ গবেষণায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এপ্রিলে ব্যামল্যানিভিম্যাবের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন বাতিল করে। ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর না হওয়ার অনেকগুলো ঘটনার তথ্য পাওয়ার পর একটি একক পদ্ধতি হিসেবে ব্যামল্যানিভিম্যাব ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায় সংস্থাটি।