সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এখন বেশিরভাগ বিকালে হোম অফিসের কাজ শেষে বাইসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামেন এই তরুণী। শহরতলীর পথ ধরে শহরের দিকে এগিয়ে যান খানিকটা।
ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের প্রকল্প ব্যবস্থাপক গ্রিউ বলেন, “আমাকে এখন অনুশীলনের চেষ্টা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে দূরত্ব বাড়িয়ে আরেকটু দূরের পথ অতিক্রম করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ম্যারাথনে দৌঁড়ানোর প্রশিক্ষণ যেভাবে হয়, সেইরকম।”
নিজের চেনা অফিসে ফিরতে তাকে এত প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে কেন? সেজন্য অনুশীলনের কথাই বা আসছে কেন?
কারণ দীর্ঘ লকডাউনের দিনগুলোতে কিটি গ্রিউয়ের মনের ভেতরে বাসা বেঁধেছে বাইরের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ আর এক ধরনের ভীতি। বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া, এমনকি আশপাশে হাঁটতেও তার অস্বস্তি হয়। সেটা তিনি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
মহামারীর বিচ্ছিন্নতা কিটি গ্রিউয়ের মত অনেকের মনেই বড় ধরনের প্রভাব ফেলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আর সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সেই সঙ্কটের গভীরতা বোঝার চেষ্টা করেছেন সিএনএন এর এলিজা ম্যাকিনটশ।
কিটি গ্রিউ তার এই ‘বাড়ির বাইরে যাওয়ার’ অনুশীলনকে বর্ণনা করেছেন ‘এক্সপোজার থেরাপি’ নেওয়ার মত এক ধরনের অভিজ্ঞতা হিসেবে। অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরে আবার কর্মস্থলে ফিরে যেতে ধীরে ধীরে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
গ্রিউ বলেন, “যখন আমি বাইরে যাই, গন্তব্য যদি আমার বাসা থেকে দূরে হয়, আমার হৃদকম্প শুরু হয়, বুক ভারী হয়ে আসে। কিন্তু আমাকে তো এখন এর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে।”
ব্রিটেন যখন করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধের শেষ কড়াকড়িটুকুও শিথিল করতে যাচ্ছে, গ্রিউয়ের মত অনেক ব্রাইটনের কাছেই কর্মস্থলে ফেরা, ভিড়ে ঠাসা গণপরিবহনে চড়া বা বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত পাবে একটু পান করার বিষয়গুলোকে আতঙ্কের না হলেও, স্বাভাবিকতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা বলে মনে হচ্ছে।
গ্রিউ বলেন, “আমার অনেক বন্ধুই একভাবে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। যখনই বিধিনিষেধগুলো শিথিল হতে শুরু করেছে, তাদের কারও কারও তো ক্লাবে যাওয়ার তর সইছে না, উৎসবে বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে। আর আমার অবস্থা উল্টো। শুধু বাসে চড়ে অফিস যাওয়ার কথা ভাবতেই আমি ঘেমে উঠছি।”
বিদেশে যাওয়ার জন্য বিমানে চড়ার কথা, এমনকি শহরের কোনো ক্লাবে যাওয়ার কথাও এখন ভাবতে পারেন না তিনি। এ অবস্থা কাটিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একজন থেরাপিস্টের কাছে যেতে হচ্ছে গ্রিউকে।
সরকারের এই পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনেকে অখুশি হয়েছেন, যারা যত দ্রুত সম্ভব বিধিনিষেধের শেষ দেখতে মরিয়া।
তাদের প্রতিক্রিয়ার নমুনা পাওয়া যায় টুইটারে ‘আইএমডান’ হ্যাশট্যাগে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন পোস্টে। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলোও বড় শিরোনামে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, সানের শিরোনাম ছিল ‘উইল উই এভার বি ফ্রি?’
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এ সপ্তাহে তার যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরার মত বিষয়গুলোতে আইনি বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে।
তবে একইসঙ্গে তিনি কড়া সতর্কবাণী দিয়ে বলেছেন, “এই মহামারীর সমাপ্তি এখনও বহু দূর এবং অবশ্যই ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে এটা কেটে যাচ্ছে না।”
যুক্তরাজ্যজুড়ে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা এখনও বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি জনগণকে এই আশা দিতে চাই না যে, কোভিডের অবসান হয়ে গেছে... এটা এখনও অনেক দূরের পথ।”
মনোবিদদের কারও কারণও ধারণা, লকডাউনের সময়ে যে উচ্চ মাত্রায় উদ্বেগ ও হতাশা অনেক মানুষের ভেতরে কাজ করছে, বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও তা কাটতে সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ড. বিবেক মূর্তিও সতর্ক করে বলেছেন, মহামারীর কারণে অভাবনীয় মানসিক চাপ ও আইসোলেশনের কষ্ট থেকে একটি ‘সামাজিক মন্দা’ তৈরি হতে পারে, যা স্বাস্থ্য, মানসিক শান্তি, এমনকি উৎপাদন ক্ষমতাতেও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
সেই দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব কেমন হতে পারে, তার বিশদ ধারণা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা বলছেন, লকডাউনে থেকে মানুষের মধ্যে যেসব আচরণ গড়ে উঠেছে, যেমন অতিমাত্রায় পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস, মানুষের সাথে মিশতে অস্বস্তি বা ভীতি, সন্দেহ হলেই কোভিড পরীক্ষা, এসব সরিয়ে আবার সমাজের স্বাভাবিক আচরণে ফেরা অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারীর প্রভাব নির্ণয়ে যুক্তরাজ্যজুড়ে গবেষণা চালাচ্ছে ব্রিটেনের মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশন। জরিপে পাওয়া ফল জানিয়ে তারা বলেছে, জানুয়ারিতে তৃতীয়বার লকডাউন বলবৎ করার পর আগেরবারের মত অতটা উদ্বেগ বোধ করেননি ব্রিটেনের বেশিরভাগ মানুষ। তবে একাকিত্বের বোধ এবং মানসিক ক্লান্তি বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন আগের চেয়ে বেশি মানুষ।
ফাউন্ডেশনের প্রধান ক্যাথেরিন সেইমোর বলেন, নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার, যেমন তরুণ জনগোষ্ঠী, কর্মহীন ব্যক্তি, একক বাবা-মা এবং আগেও মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে ভুগেছেন, এমন বক্তিরা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, সামাজিক জীবনযাপনে বিধিনিষেধ এবং টিকা প্রাপ্তির তালিকার শেষাংশে অবস্থান করায় তরুণরা কষ্টের ভার বহন করছে।
কিছু মনোচিকিৎসক এবং অচরণবিদের মতে, মহামারী পার করার পর তরুণরা আরও দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে উঠে আসতে পারবে বলে যে বিশ্বাস ছিল, সবার ক্ষেত্রে তা নাও টিকতে পারে।
দক্ষিণ লন্ডনের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক দাতব্য সংস্থা মাইন্ড ইন ক্রয়ডনের উপ-প্রধান নির্বাহী এমা টারনার বলেন, যেহেতু জনগণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে শুরু করছে, এখন তাদের সেবাগ্রহিতাদের সংখ্যা বাড়বে বলে তার ধারণা। গত এক বছর ধরে মাইন্ডের পরামর্শ সেবা পরিচালিত হচ্ছিল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। সবার তা নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
লন্ডনের লেখক জেসিকা প্যান জানান, প্রথম লকডাউনের সময় যখন তিনি জানতে পারলেন যে, প্রথম সন্তান তার গর্ভে, তখন থেকে একাকিত্বের বোধ আর এক ধরনের ভীতি তার মধ্যে তৈরি হয়।
এ বছর জুনে গরমের সময় এক বন্ধুর বাগানে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। সেখানে পুলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তার ছোট্ট ছেলেটিও খেলেছিল জীবনে প্রথমবার। পরদিন বাড়ি ফিরে দেখেন ছেলের জ্বর। এরপর তার মধ্যে ওই নিমন্ত্রণে যাওয়া নিয়ে আফসোস শুরু হয়।
তিনি বলেন, “আমার সৌভাগ্য যে ছেলের করোনাভাইরাস নেগেটিভ এসেছিল। তবে ঝুঁকি নেওয়াটা মোটেই উচিত হয়নি। আমার কোভিড হল কিনা, অথবা আমি আমার ছেলেকে কোভিডে আক্রান্ত করে ফেললাম কিনা- এসব ভেবে রাতের ঘুম হারাম করতে আমি রাজি নই।”
জেসিকা প্যান বলেন, “মুক্ত-স্বাধীন, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকার সামর্থ্য আমার বোধহয় চলে গেছে এবং এটা খুবই কষ্টদায়ক।”
কিটি গ্রিউ জানান, সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়েছেন তারা। সেখানে প্রত্যেককে নিজেদের অনুভূতি জানিয়ে দুটো শব্দ টাইপ করতে বলা হয় এবং জরিপের ফল থেকে পাওয়া শব্দগুলোর একটি গুচ্ছ তৈরি করা হয়।
“আমি বলেছিলাম, আমি ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন বোধ করছি। এখন পর্যন্ত জরিপে এ দুটো শব্দই সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, “এভাবে আলাদা হয়ে থাকার একটি সমস্যা হচ্ছে, আপনি প্রায়ই ভাবতে পারে, ‘আমি একজন উন্মাদ। বাকি প্রত্যেকেই ভালো আছে এবং ভালোই সময় কাটাচ্ছে, শুধু আমিই সত্যিকার অর্থে কষ্ট করছি।’ ফলে আপনি যখন জানবেন যে অন্যরাও আপনার মতই বোধ করছে, তখন কিছুটা স্বস্তি পাবেন।”