করোনাভাইরাস: ‘ডেল্টা ধরনের’ বিরুদ্ধে কোন টিকা কতটা কার্যকর?

পুরো বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরন ‘ডেল্টা’। ভাইরাসের এ ধরনটির বিরুদ্ধে কোন টিকা কতটা কার্যকর তা জানার চেষ্টায় চলছে নানা পরীক্ষা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2021, 07:28 PM
Updated : 6 July 2021, 04:16 AM

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের নাজুক অবস্থার জন্য করোনাভাইরাসের এ ভ্যারিয়েন্টটিকে (বি.১.৬১৭.২) দায়ী করা হচ্ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ধরনটিকে ‘বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সেই শঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ইতোমধ্যে শতাধিক দেশে ছড়িয়েছে পড়েছে এ ধরন।

বাংলাদেশেও এ ধরনটির দাপটের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইডিসিআর জানিয়েছে, গত জুন মাসে দেশে কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশই ডেল্টা ধরনের।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মনিকা গান্ধীকে উদ্ধৃত করে ব্লুমবার্গ লিখেছে, যেসব টিকা এ পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে, তার সবগুলোই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা দেখিয়েছে।

“কিছু ক্ষেত্রে হয়ত দেখা গেছে টিকা দেওয়ার পরও মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, তবে তাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ ও অসুস্থতার মাত্রা অনেকটাই কম।”

তবে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, ডেল্টা ধরনের ক্ষেত্রে সব টিকার কার্যকারিতা সমান নয়।

বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের আটটি টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো হল: ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার তৈরি স্পুৎনিক-ভি, চীনের সিনোফার্মের তৈরি টিকার বিবিআইবিপি-সিওরভি (BBIBP-CorV), চীনের সিনোভ্যাকের টিকা করোনাভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের তৈরি করা  কোমির্নাটি, মডার্নার স্পাইকভ্যাক্স, জনসন অ্যান্ড জনসনের জ্যানসেন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন এবং চীনের ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজি অব দ্য চাইনিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্স (আইএমবি ক্যাম্পস) উদ্ভাবিত নতুন একটি টিকা, যা এখনও পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে রয়েছে।

এর মধ্যে কোভিশিল্ড দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে গণ টিকাদান শুরু হয়। পরে ফাইজার ও সিনোফার্মের টিকা পাওয়ার পর এখন সেই টিকাও দেওয়া হচ্ছে। কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার টিকাও দেশে এসেছে কয়েকদিন আগে। তবে এখনও প্রয়োগ শুরু হয়নি। 

ফাইজার-বায়োএনটেক

এপ্রিল থেকে জুনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ১৪ হাজার রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড।

গত ১৪ জুন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের বরাতে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা ফাইজারের একটি ডোজ নিয়েছেন, চার সপ্তাহ পর দেখা গেছে, তাদের ৩৬ শতাংশের ক্ষেত্রে এ টিকা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে। দুই ডোজের পর তা বেড়ে ৮৮ শতাংশ হয়েছে।

তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা করোনাভাইরাসের অন্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছিল।

পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের এক ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ৯৪ শতাংশ কোভিডে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়া থেকে রেহাই পেয়েছেন। আর দুই ডোজের নেওয়া ব্যক্তিদের ৯৬ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। 

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা, যা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

অ্যাস্ট্রাজেনেকা

পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার এক ডোজ ‘ডেল্টা ধরনের’ বিরুদ্ধে ৩০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। আর দুই ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের ৬৭ শতাংশের ক্ষেত্রে এই টিকা সুরক্ষা দিতে পেরেছে।

অথচ ইংল্যান্ডে পাওয়া আলফা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দুই ডোজে ৭৪ শতাংশ কার্যকারিতা দেখা গেছে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের কারও সংক্রমণ ঘটলেও ৭১ শতাংশ মারাত্মক অসস্থ হননি বা হাসপাতালে যেতে হয়নি। আর দুই ডোজের ক্ষেত্রে এই সুরক্ষার মাত্রা ৯২ শতাংশ।

বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা দিয়েই গণ টিকাদান শুরু হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং কর্মচারীদের মধ্যে যারা এই টিকার দুটি ডোজ নিয়েছেন, তাদের ৯৩ শতাংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এক ডোজ নেওয়া পর তাদের ৪১ শতাংশের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি পাওয়া গিয়েছিল।

টিকা নেওয়া ৩০৮ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ সম্প্রতি এই ফলাফল প্রকাশ করে।

মডার্না

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গিয়েছিল মডার্নার টিকা ৯৪.১ শতাংশ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে। তবে তখনও ডেল্টা ধরনের উদ্ভব হয়নি।

মডার্নার টিকাও ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার মত একই পদ্ধতিতে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির এক গবেষণার বরাত দিয়ে এনবিসি বস্টনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মর্ডানার টিকার এক ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৮০ শতাংশ এবং দুই ডোজ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ওষুধ ও জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘মডার্না’র টিকায় তৈরি হওয়া ‘অ্যান্টিবডি’র মাত্রাও ডেল্টা ধরন ৭ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।

মডার্না বলেছে, তাদের টিকা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে বেটা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ভালো ফল দেখিয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

জনসন অ্যান্ড জনসন

জনসন অ্যান্ড জনসন (জেঅ্যান্ডজে) সম্প্রতি জানিয়েছে, তাদের এক ডোজের টিকা অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধেও কার্যকর এবং টিকা নেওয়ার পর আট মাস পর্যন্ত এর কার্যকারিতা থাকে।

সাম্প্রতিক দুটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জনসন অ্যান্ড জনসন বলেছে, ভাইরাসের মূল ধরনটির বিরুদ্ধে তাদের টিকা যতটা কার্যকর, তার চেয়ে ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে সামান্য কম কার্যকর। তবে সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া বেটা ধরনের চেয়ে ভারতে শনাক্ত ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে এ টিকা বেশি কার্যকর।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছিল জনসনের টিকা। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা কত শতাংশ থাকে, সেই সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন ও তারা প্রকাশ করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষের সাবেক এক কমিশনারের বরাত দিয়ে এনবিসি বস্টনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেল্টার বিরুদ্ধে জনসনের কার্যকারিতা ৬০ শতাংশের মত।  

স্পুৎনিক ভি

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রথম টিকা তৈরির ঘোষণা দিয়েছিল রাশিয়া, তাদের সেই টিকার নাম স্পুৎনিক ভি। মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি করা ওই টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯১ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছিল।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এ টিকার কার্যকারিতা নিয়ে স্বাধীন কোনো গবেষণা এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে গামালিয়া ইনস্টিটিউট জুনের শেষে দাবি করেছে, করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ওই ধরনটির বিরুদ্ধেও তাদের টিকা ৯০ শতাংশের মত কার্যকারিতা দেখিয়েছে। 

চীনের তিন টিকা

করোনাভাইরাসের কোন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে চীনের কোন টিকা কতটা কার্যকর সে বিষয়ে বড় কোনো গবেষণার বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি দেশটি। সে কারণে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে।

তবে চীনা বিশেষজ্ঞরা দাবি করে আসছেন,  ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও তাদের তৈরি টিকাগুলো কর্যকর এবং গুরুতর অসুস্থতা ঠেকাতে সক্ষম।

চীনা সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞা জং নানশানকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, যে গবেষণার ভিত্তিতে তারা কার্যকারিতার কথা বলছেন, তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।  

সিনোভ্যাকের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রক্ষ পরীক্ষা করে তারা দেখেছেন, ডেল্টা ধরনের সংক্রমণে ক্ষেত্রে তাদের টিকার ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তবে দুই ডোজের বুস্টার শট দিলে ডেল্টার বিরুদ্ধেও টেকসই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে শরীরে।  

চীনের সিনোভ্যাক তাদের কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল, কিন্তু হয়নি। ছবি: রয়টার্স

চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভনশনের সাবেক উপ-পরিচালক ফেং জিয়াং সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সেন্ট্রাল টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চীনে তৈরি দুটি টিকা ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে ‘কম কার্যকর’। তবে তিনি টিকা দুটির নাম উল্লেখ করেননি।

তবে তিনি জানিয়েছেন, ওই টিকা দুটি ‘মৃত করোনাভাইরাস’ থেকে তৈরি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’ এর ধরনে পড়েছে।

এ ধরনের টিকায় পরীক্ষাগারে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে সেটাকে মেরে ফেলার পর টিকায় ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে ওই ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।

চীনে গণটিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহার করা দেশটির তৈরি সাতটি টিকার মধ্যে পাঁচটি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’। এর মধ্যে সিনোভ্যাক বায়োটেক এবং সিনোফার্মের টিকাও রয়েছে। 

সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা বিবিআইবিপি-সিওরভি (BBIBP-CorV) পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকরিতা দেখিয়েছিল বলে উৎপাদনকারীদের ভাষ্য। আর সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্সেস কোম্পানির তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৫১ শতাংশ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে দেখা গিয়েছিল।

আর আইএমবি ক্যাম্পসের টিকা এখনও পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে থাকায় এক কার্যকারিতা সম্পর্কিত কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি।