কোভিড: দৈনিক শনাক্তের হার ফের ১৫ শতাংশের বেশি

পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত রোগীর হার ৬ শতাংশে নেমে আসায় মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনেকে আশা দেখতে শুরু করেছিলেন, ভেবেছিলেন করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশ হয়ত পেরিয়ে এসেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2021, 07:52 PM
Updated : 16 June 2021, 07:58 PM

কিন্তু এ ভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এক মাসের মাথায় দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার নিয়ে গেছে ফের ১৫ শতাংশের উপরে।  ‍

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫১৩টি ল্যাবে ২৩ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

তাতে সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৩ হাজার ৯৫৬ জনের মধ্যে, যা প্রায় আট সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার দাঁড়াচ্ছে ১৬ শতাংশের বেশি। 

গতবছর মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর গত ১৫ মাসে পরীক্ষার বিপরীতে গড় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।  দৈনিক শনাক্তের হার গত তিন দিন ধরেই তার চেয়ে বেশি থাকছে।

শনাক্তের পারে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ খুলনা বিভাগে, সেখানে দৈনিক এই হার থাকছে ৪০ শতাংশের বেশি; রাজশাহীতে থাকছে ২০ শতাংশের কাছকাছি।

 

সংক্রমণ বাড়ার মানে হল মৃত্যুও বাড়বে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত এক দিনে ৬০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে, যা দেড় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে দেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন, নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর অনেক সংখ্যা সরকারের খাতায় আসছে না।

গত এক দিনে সারা দেশে ২৪ হাজারের কম নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, যেখানে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়েরে মধ্যে ১২ এপ্রিল প্রায় ৩৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল।

দেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার ল্যাব বাড়লেও পরীক্ষার সংখ্যা সে অনুযায়ী বাড়েনি। গত দেড় বছরে সারা দেশে মাত্র ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৭৮৬টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে যেখানে কেবল ঢাকার জনসংখ্যাই ২ কোটির বেশি।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ৬ এপ্রিল দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার ৫ শতাংশের ওপরে উঠে গিয়েছিল। মের শেষ দিক থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা ২০ শতাংশের উপরেই থাকে। এর মধ্যে ১২ জুলাই তা ৩৩.০৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

সংক্রমণের প্রথম ঢেউ সামলে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিনশর ঘরে নেমে এসেছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় দুই মাস দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী পরপর দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সে কারণে বিশেষজ্ঞরাও তখন আশা দেখতে শুরু করেছিলেন।

তাছাড়া ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশে গণটিকাদান শুরু হয়। ফলে সেটাও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহস যোগাচ্ছিল।

কিন্তু মার্চে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যায়। এপ্রিলের শুরুতে হাসপাতালে শয্যার জন্য শুরু হয় হাহাকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ফের কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধ ফিরিয়ে আনতে হয়।

সে সময় মাত্র ১৬ দিনে এক লাখ মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ১৫ দিনেই এক হাজার কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু ঘটে, ১৯ এপ্রিল রেকর্ড ১১২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ওই সময়টাকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় যেমন দ্রুত গতিতে শনাক্ত ও মৃত্যুর গ্রাফ উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছিল, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একইরকম দ্রুততায় তা নেমে আসতে শুরু করে।

মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মোটামুটি দুই সপ্তাহ দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেড় হাজারের ভেতরেই ওঠানামা করছিল। তাতে সরকারের মন্ত্রীরাও দ্বিতীয় ঢেউ সামলে ওঠার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। 

কিন্তু জুনের শুরু থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগী আবার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দেড় মাস পর সোমবার দেশে আবারও এক দিনে তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর আসে।     

 

এপ্রিলে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল করোনাভাইরাসের বেটা ভ্যারিয়েন্টটি, যেটা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল।

এপ্রিল ও মে মাসে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কোভিড রোগীদের নমুনা থেকে পাওয়া ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স করেও বেটা ভ্যারিয়েন্ট বেশি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন গবেষকরা।

কিন্তু এখন সেই জায়গা নিয়েছে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, যেটা প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ভারতে। এ বছর দেশটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রেকর্ড সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য ওই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকেই দায়ী করা হচ্ছে।

মে মাসের শুরুতেই ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা শনাক্ত করা হয়, এরপর রাজশাহী ও খুলনার ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

জুনের শুরুতে আইইডিসিআর জানায়, দেশে করোনাভাইরাসের ধরনটির সামাজিক বিস্তার বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কঠোর ‘লকডাউন’ জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। চলাফেরায় ওপর দেওয়া হয়েছে কড়াকড়ি। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতির কোনো খবর আসেনি।

সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊধর্বগতির মধ্যে বুধবার সারা দেশে চলমান বিধি-নিষেধের মেয়াদ এক ধাক্কায় আরও এক মাস বাড়িয়েছে সরকার।

 

সংক্রমণের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঢাকার পরিস্থিতিই সবচেয়ে খারাপ ছিল। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে শুরু করার পর এখন উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। 

৭ থেকে ১৩ জুনের সঙ্গে তার আগের সপ্তাহের পরিস্থিতির তুলনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ সিচুয়েশন রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৩১ শতাংশ।

দেশের আট বিভাগের মধ্যে খুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ৯১.২ শতাংশ, রাজশাহীতে বেড়েছে ৮২ শতাংশ। রংপুরে ৭৩ শতাংশ।

জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী বিভাগেই প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। বুধবার আবার শীর্ষে উঠে এসেছে ঢাকা।

ঢাকা বিভাগে গত এক দিনে ১৫৭৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা সারা দেশে মোট শনাক্তের ৪০ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হয়েছিল মোট ৯০৭ জন।

ঢাকা মহানগরীসহ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ১৩৫ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। এছাড়া রাজশাহী ৩৪৩ জন, যশোরে ২০৪ জন, খুলনায় ২২২ জন, নাটোরে ১২০ জন, নওগাঁয় ১২৫ জন এবং চট্টগ্রামে ১০৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

ঢাকা জেলায় পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আগের দিনের ৫.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে এক ধাক্কায় ১০.৬ শতাংশ হয়েছে। আর ঢাকা বিভাগে ১০.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১২.৩২ শতাংশ।

রাজশাহী বিভাগে ১৬.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯.৬ শতাংশ। আর খুলনা বিভাগে শনাক্তের হার আগের দিনের মতই ৪১ শতাংশ রয়েছে।