কোভিড: ভারত কী দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে এসেছে?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত ছয় সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসায় অনেকে আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু টিকার সঙ্কটে থাকা ভারত সরকারের দুঃশ্চিন্তা তাতে কমছে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2021, 06:53 PM
Updated : 28 May 2021, 06:19 PM

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর বেশিরভাগ দিনই দুই কিংবা তিন লাখ, কখনো কখনো চার লাখেরও বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।

সরকারি হিসাবে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দুই কোটি ৭৫ লাখের বেশি । এ দিক দিয়ে বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্রের পরই ভারতের অবস্থান।

মৃত্যুর সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পরে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত; মাত্র কয়েক দিন আগে তিন লাখ মৃত্যুর দুঃখজনক মাইলফলক পেরিয়ে এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশটি।

সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্যের সঙ্গে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভারতে মহামারীর গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কি তবে শেষ হচ্ছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ থিতিয়ে আসতে শুরু করেছে।

সাত দিনের গড় হিসাবে ভারতে দৈনিক নতুন রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ৯২ হাজারের ঘরে ওঠার পর গত দুই সপ্তাহ ধরে তা কমে আসছে। তবে সব রাজ্যের বাস্তবতা এক নয়।

মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং ছত্তিশগড়ে সংক্রমণ কমলেও তামিল নাডুতে বাড়ছে। উত্তর পূর্বঞ্চল এবং অন্ধ্র প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও স্পষ্ট নয়।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডা. রিজো এম জন বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি সব অঞ্চলে এক রকম নয় এবং বেশ কিছু রাজ্যে এখনও দৈনিক শনাক্তের হার উপরে উঠছে। তবে প্রধান শহরগুলোতে সংক্রমণ কমে আসছে।

আর মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটি লন্ডনের গণিতবিদ ডা. মুরাদ বনাজির মতে, ভারতের গ্রামাঞ্চলের সংক্রমণের তথ্য ঠিকঠাক না আসায় আসল পরিস্থিতি বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।  

“এমনও হতে পারে যে জাতীয় পর্যায়ে আক্রান্তের হার এখনও হয়তে চূড়ায় পৌঁছেনি। কিন্তু সেটা শনাক্তের সংখ্যা দিয়ে বোঝা যাবে না, কারণ এখন প্রত্যন্ত এলাকাতেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।” 

চেন্নাইয়ের ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সেস এর গবেষক ডা. সিতাভ্রা সিনহা বলেন, স্থানীয় পর্যায়েরর চিত্রের এমন অস্পষ্টতার কারণে এটা অনুমান করা কঠিন যে ভারতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমে আসার এই ধারা স্থায়ী হবে কিনা।

করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসা ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিশিয়ান ভ্রমর মুখোপাধ্যায়ও এ বিষয়ে একমত।

তিনি বলেন, ভারতের রাজ্যগুলোতে যখন সঙ্কটের কেবল শুরু হচ্ছে, তখন জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ কমে আসার ওই পরিসংখ্যান মিথ্যা প্রবোধ দিতে পারে। কোনো রাজ্যই যে এখনও পুরোপুরি নিরাপদ হয়ে ওঠেনি, এটা স্পষ্ট করা দরকার।

ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য কোনো ধারণা দিচ্ছে?

কোনো সংক্রামক রোগ কতটা দ্রুত ছড়াবে, আরও স্পষ্ট করে বললে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কতজন আক্রান্ত হবে- সেই সংখ্যা হিসাব করার জন্য ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকে ধারণা নেওয়া হয়, যাকে চিহ্নিত করা হয় ‘আর নট’ ও ‘আর’ দিয়ে।   

দুটোর মধ্যে পার্থক্য হল, মহামারীর শুরুতে পুরো জনসংখ্যা যখন সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, তখন ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যাকে চিহ্নিত করা হয় ‘আর নট’ দিয়ে। আর যখন মহামারী চলমান, কিছু লোক আক্রান্ত হয়ে ভালো হয়েছে উঠেছে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তখন ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যাকে ‘আর’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

ডা. সিতাভ্রা সিনহা জানান, ভারতে ‘আর’ এর সংখ্যা গত ৯ মে নেমে এসেছে ১ এর নিচে।

“এই ধারা যদি স্থায়ী হয় এবং আগামী সপ্তাহগুলোতে যদি তা আরও কমে আসে, তাহলে আমরা সংক্রমণের হার দ্রুত কমে যাওয়ার আশা করতে পারি।”

কিন্তু ভারতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় এই ‘আর’ সংখ্যাটি ১ এর কাছাকাছি ছিল। ফলে সংখ্যা যেন ভুল ধারণা না দেয়, সে বিষয়ে সতর্ক করছেন ডা. সিনহা

“এমনটা হতেই পারে যে, কোনো রাজ্যে সংক্রমণ ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। গ্রাফ উপরে ওঠার শুরু করার আগে সেখানে সক্রিয় সংক্রমণ কম থাকলেও ‘আর’ অনেক বেশি থাকতে পারে।”

দ্বিতীয় ঢেউয়ের শেষ কোথায়?

সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ধীরে কমছে। গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে আক্রান্তের হার কমতে শুরু করে, যা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে আক্রান্তের হার কমেছে দ্রুততার সঙ্গে, এর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর একটি কারণ হতে পারে যে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছে এবং তাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরনের কারণে সৃষ্ট দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদেরতো ভাইরাসের নতুন ধরনের বিরুদ্ধে পুরো প্রতিরোধ ক্ষমতা নাও থাকতে পারে।

বায়োস্ট্যাটিসটিসিয়ান ভ্রমর মুখোপাধ্যায় জানালেন, তার হিসাব বলছে, মে মাসের শেষে ভারতে দৈনি শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেড় লাখ থেকে দুই লাখের মধ্যে নেমে আসতে পারে। আর জুলাইয়ের শেষে তা ফিরে যেতে পারে গত ফেব্রুয়ারির পর্যায়ে।

তবে ভারতের রাজ্যগুলো লকডাউন থেকে কীভাবে বের হয়ে আসবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে মনে করে তিনি।

সংক্রমণের হার কমপক্ষে ১৪ দিন পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে কেবল তখনই কোনো এলাকা থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া নিরাপদ বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডা. জন বলেন, ভারত যদি গড়ে দৈনিক ১৮ লাখ নমুনা পরীক্ষা করে এবং এর মধ্যে ৯০ হাজার  পজিটিভ ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশ হবে।

“তখন বলা যেতে পারে যে এটা একটা ভালো লক্ষণ।”

মৃত্যু বাড়ার কারণ কি?

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিন লাখের বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে- এমন তৃতীয় দেশ হল ভারত।

পরীক্ষা কম বলে সংক্রমণ ও কোভিডে মৃত্যুর অনেক ঘটনা সরকারি গণনার বাইরে থেকে যায়। ফলে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

গণিতবিদ ডা. মুরাদ বনাজি বলেন, সংক্রমণ যখন বাড়ে, মৃত্যুর সংখ্যায় তার প্রভাব পড়ে এক বা দুই সপ্তাহ পরে। ভারতে দৈনিক শনাক্ত কমে এলও মৃত্যু সেভাবে না কমার এটি একটি কারণ।

পাশাপাশি আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে এবং রাজ্যগুলোর মধ্যেও নানা ধরনের ভিন্নতা আছে।

“তালিকায় মৃত্যু কমে এলেও গ্রামাঞ্চলে মৃত্যুর যে বড় সংখ্যা, তা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সতর্ক হয়ে হিসাব করতে হবে।”

বায়োস্ট্যাটিসটিসিয়ান ভ্রমর মুখোপাধ্যায় জানালেন, মধ্য মে থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে আরও অনেক মৃত্যু দেখতে হবে ভারতকে। তার পরিসংখ্যান মডেল অনুযায়ী, এই সংখ্যা এক লাখও হতে পারে।

ভারতের দ্বিতীয় ঢেউকে অন্য দেশে সঙ্গে তুলনা করা যায়?

যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ খুব দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে আবার দ্রতই পড়ে গিয়েছিল এবং দুই দেশেই তা জানুয়ারির শুরুতে চূড়ায় উঠেছিল।

অবশ্য অন্য দেশের এই চিত্রের সঙ্গে ভারতের তুলনা করতে যাওয়া ঠিক হবে বলে মনে করেন না বিজ্ঞানী সিতাভ্রা সিনহা।

তিনি জানান, ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলেই দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে সর্দি-জ্বরের মৌসুম নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে।

অন্যান্য বছরও ওই সময়টায় বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখানে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন, তাই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না।

আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে একেক দেশে সংক্রমণের হার কমতে একেক রকম সময় নিয়েছে।

ডা. সিনহা জানান, জার্মানির ক্ষেত্রে প্রথম ঢেউয়ের চূড়া থেকে নেমে আসতে যতটা সময় লেগেছিল, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি সময় লেগেছে। আবার ফ্রান্সে দুই বারই সময় লেগেছে একই রকম।

“ইউরোপের সর্দি-জ্বরের মৌসুমের সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ কমার হার বুঝতে বিশ্বজনীন কোনো সূত্র ব্যবহার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না।”

এরপর কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে এখন লকডাউন থেকে বের হয়ে আসতে আরও বেশি সূক্ষ্ম ও কৌশলী পরিকল্পনা করতে হবে।

রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া, পাব, কফিশপ এবং জিমের মতো উচ্চ ঝুঁকির স্থানগুলো দেরি করে খোলার অনুমতি দেওয়া উচিত।

ভ্রমর মুখোপাধ্যায় বলেন, উন্মুক্ত স্থানে জড়ো হওয়ার ক্ষেত্রে খোলা বাতাস আছে এমন জায়গায় ১০ জনের কম লোকের জনসমাগমের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। গ্রীষ্মকালে এয়ার কন্ডিশনড হলে বিয়ের অনুষ্ঠান ‘ভাইরাসের আস্তানা’ হঃেয় উঠতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল টিকা দেওয়ার গতি বাড়াতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ ও গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারী তত্ত্ব এবং তথ্য সারণীর মাধ্যমে ভাইরাসের নতুন ধরনটির গতিবিধি এবং সংক্রমণের সামন্যতম পরিবর্তনকেও নিবিড়ভাবে অনুধাবন করতে হবে।

ভাইরাসের দিন শেষ হয়ে আসছে- এমন ভাবাটা মারাত্মক ভুল হতে পারে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন ডা. মুরাদ বনাজি।

তিনি বলছেন, যারা আগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের নতুন একটি ধরনের ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা আবারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন এবং হয়ত রোগ ছড়াবেন।

ভারতে এপর্যন্ত ১০ শতাংশ মানুষকে এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। পুরো জনসংখ্যার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ পুরোপুরি টিকার আওতায় না আসা পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবযাত্রায় ফেরার চেষ্টা ভুল হবে বলেই মনে করছেন ডা. জন।

তার আগ পর্যন্ত সবাই মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, পরিচ্ছন্নতা, জনসমাগম পরিহার করাসহ কোভিড আচরণবিধি মেনে চললে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।

ডা. সিনহা বলেন, “কোভিড- ১৯ এর বিরুদ্ধে আগের মত বিজয় ঘোষণার করলে আবারও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, সেরকম পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।”