কোভিড-১৯: তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরে সমস্যাটা কী?

নিজেদের অনেক সাফল্যের গল্পের মত করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেও প্রশংসিত হয়েছে শক্ত অর্থ-সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান। বছরের শুরুতেও তাদের সংক্রমণের হার শূন্যের কোঠায়, নয়ত এক অঙ্কের ঘরে ছিল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2021, 06:03 PM
Updated : 22 May 2021, 06:03 AM

কঠোর বিধিনিষেধ, জনসমাগমে কড়াকড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার পরও চলতি মাসে দুই জায়গাতেই সংক্রমণ ভিন্নরূপ পেয়েছে; হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে সংক্রমণ। সিঙ্গাপুরে গত সপ্তাহে ২৪৮ জন আর তাইওয়ানে ১২০০ জন সংক্রমিত হয়েছেন প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে।   

বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় অংক দুটি ছোট হলেও তা সরকারের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন হঠাৎ করে বদলে গেল পরিস্থিতি? সমস্যাটাই বা কী?

সেই কারণ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

তাইওয়ান: ‘আত্মতুষ্টির’ গল্প

চীনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কারণে জরুরি অবস্থা জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাইওয়ান বিদেশিদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ নিয়ে জনগণের মত সরকারের মধ্যেও এক ধরনের আত্মতুষ্টি কাজ করেছিল।

ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক লি সিয়েন-হো’র ভাষ্য, হাসপাতালগুলোতে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি সংক্রমণের স্বাভাবিক লক্ষণ জ্বর থাকলেও পরীক্ষা করা হত না। 

তার দাবির সত্যতা মেলে ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র তথ্যেও। অনলাইনে প্রকাশিত তাদের তথ্যে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে তাইওয়ানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার হার ছিল প্রতি হাজারে মাত্র শুন্য দশমিক ৫৭ জন। যেখানে সিঙ্গাপুরে এই হার ছিল ছয় দশমিক ২১ এবং যুক্তরাজ্যে আট দশমিক ৬৮।

ড. লি বলেন, “কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য- এমন সাধারণ ধারণা সবার মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ভাইরাস তাইওয়ানের শক্তিশালী সীমান্ত পারই হতে পারবে না, এমন বিশ্বাস থেকেই এটি তৈরি হয়েছিল।

“চিকিৎসকরা বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি, হাসপাতালগুলো সতর্ক ছিল না, তারা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংও করত না। সব মিলিয়ে অবশ্যই আত্মতুষ্টির একটা বিষয় কাজ করেছে।”

তাইওয়ানে বিধিনিষেধে ঢিলেঢালা ভাব যে এসেছিল, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। টিকা নেননি এমন বৈমানিকদের প্রথমদিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও পরে সেটি কমিয়ে পাঁচদিন এবং দ্বিতীয় দফায় তিনদিনে নামিয়ে আনা হয়।

এর কিছুদিন পর চায়না এয়ারলাইন্সের একদল বৈমানিকের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে, যারা তাওইউয়ান বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন।

সংক্রমিত দলটির সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষায় পরে ভাইরাসটির বি.১.১.৭ নামের ব্রিটিশ ধরনটির অস্তিত্ব মেলে।  

এরপরই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াতে শুরু করে, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘টি হাউসগুলোতে’ এর অস্তিত্ব মিলতে থাকে।

“একটি আবদ্ধ জায়গায় দলবেঁধে মানুষ আসছে-যাচ্ছে, গান গাইছে, পান করছে। শুধু টি হাউসেই নয়, অনেক জায়গাতেই ব্যাপকভাবে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে,” বলেন ড. লি।

মহামারী বিশেষজ্ঞ এবং তাইওয়ানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক চেন চিয়েন-জেন বলেন, টি হাউস ঘুরে আসা অনেকের নমুনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ এলেও তা তারা প্রকাশ করতে চাননি। ফলে কনট্যাক্ট ট্রেসিংও কঠিন হয়ে গেছে।

“মানুষের ছোট একটি অংশের নিয়মভঙ্গ যে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, এই ঘটনা আমাদের সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছে।”

এই বিশেষজ্ঞের মতে, জাপানের এমন বিনোদনকেন্দ্রগুলোর কি অবস্থা হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে তাইওয়ান। বন্ধ করে দেওয়ার আগে জাপানে প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনকেদন্দ্রগুলো ছিল ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম ক্ষেত্র।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের (এনইউএস) সহযোগী অধ্যাপক অ্যালেক্স কুক মনে করেন, দেশের ভেতরে সংক্রমণ ঠেকানোর মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু কঠোরভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করার যে ঝুঁকি, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাইওয়ানে।

সিঙ্গাপুর: বিধিনিষেধের দেয়ালেও ফাটল

সিঙ্গাপুরের ঘটনা অবশ্য ভিন্ন। দেশটিতে সংক্রমণের হার কম থাকলেও কড়াকড়িতে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। আটজনের বেশি জড়ো না হওয়া, ক্লাবগুলো বন্ধ এবং বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে বড় জনসমাগমে কড়াকড়ি এখনও আছে। 

কিন্তু সিঙ্গাপুরে এখনও বড় ঘাটতি রয়ে গেছে টিকার ক্ষেত্রে। ফলাফল- মে মাসের শেষ দিকে এসে চাঙ্গি বিমানবন্দর হয়ে উঠেছে দেশটিতে সবচেয়ে বড় সংক্রমণের স্থান।   

পরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ এমন একটি জোনে কাজ করেছিলেন, যেখানে সংক্রমণের উচ্চঝুঁকির দেশগুলো থেকে লোকজন এসে জড়ো হত। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যাত্রীরাও ছিলেন।

বিদেশি এই শ্রমিকদের কেউ কেউ বিমানবন্দরের উন্মুক্ত ফুডকোর্টে খাওয়া-দাওয়া করেছেন, ফলে সেখানেও আরেক দফা সংক্রমণ ছড়িয়েছে।

এ ঘটনার পর বিমানবন্দরের যাত্রী টার্মিনালগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সিঙ্গাপুর।

নতুন করে সংক্রমিতদের মধ্যে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেটি খুব দ্রুত ছড়াতে সক্ষম।

সিঙ্গাপুরের বিমানবন্দরে এখন সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশ এবং কম ঝুঁকির দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া বিমানবন্দরের কর্মীরাও কাজ করবেন নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে।

মাসখানেক আগে এসব ফাঁকফোকরের কথা বলা হলেও এসব ব্যবস্থা কেন আগেভাগে নেওয়া হল না, এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

অবশ্য ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক তিও ইক ইংয়ের মতে, ভাইরাসের নতুন ধরনটির সিঙ্গাপুরে আসাটা ছিল ‘অনিবার্য’।

“মানুষ কেন হতাশ সেটা আমি বুঝি, কারণ বেশিরভাগ নাগরিকই অতিমাত্রায় অনুগত। কিন্তু আমরা চীনের মত সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করতে পারিনি। দেশ হিসেবে, অর্থনীতি হিসেবে আমরা হচ্ছি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।

“আমরা যদি গতবছর যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে দেখি, সেখানে ভাইরাসটি চীন থেকে যায়নি, ইউরোপ থেকে যাওয়া লোকজনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তাহলে কতগুলো দেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুর সীমান্ত বন্ধ করবে? বিষয়টা শুধু একটা দেশের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার ওপর নির্ভর করে না, এটা বুঝতে হবে।”

তবে সংক্রমণ বিস্তার রোধে দেশটি এখনও খুব ভালো অবস্থানে আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক কুক।

“কোনো ভুল হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে আমার দ্বিধা আছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, জনসংখ্যার বিচারে সেখানকার চেয়ে দৈনিক সংক্রমণের হার এখানে ১০ শতাংশের আশপাশে থাকছে। অন্যদিকে ভাইরাসটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করার আগেই সিঙ্গাপুর প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।”

টিকাদানে ধীরগতি

আরও একটি সমস্যা আছে তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের, সেটি হচ্ছে টিকা।

পরিস্থিতি যখন ভালো ছিল, তখনও তাইওয়ানের অনেক নাগরিক টিকার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। এখন তাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। এই টিকা নিরাপদ হবে কিনা, সেই প্রশ্ন করছেন তারা।

সংক্রমণ বাড়তে দেখে তাইওয়ানিজরা এখন টিকা নিতে ছুটলেও, প্রয়োজনীয় পরিমাণ টিকা তাদের হাতে নেই। দুই কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশটি এখন পর্যন্ত মাত্র তিন লাখ টিকা পেয়েছে।   

টিকা উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানিতে ধর্ণা দিয়েও মেলেনি প্রয়োজনীয় টিকা। এ অবস্থায় টিকা তৈরিতেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ড. চেন।

দেশটিতে স্থানীয়ভাবে অন্তত দুটি কোম্পানি টিকা নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাছ থেকে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সুখবর মিলতে পারে আশাও করা হচ্ছে।

সিঙ্গাপুরে এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে  ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’। টিকাদানের এই হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ।

কিন্তু তাইওয়ানের মত সিঙ্গাপুরেও টিকার সরবরাহ সীমিত হয়ে এসেছে। দেশটির সরকার অবশ্য এ বছরের শেষ নাগাদ জনসংখ্যার পুরো অংশকেই টিকার আওতায় আনতে আশাবাদী।  

“সার্বিকভাবে আমাদের টিকার সরবরাহ কমে এসেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো দেশগুলো নিজেরা টিকা উৎপাদনে সক্ষম। টিকার চাহিদা দীর্ঘমেয়াদে থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা। তাই আমরা নিজেদের টিকা উৎপাদন সক্ষমতার দিকে নজর দিচ্ছি। তাহলে অন্য কারও উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে না,” বলেছেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক তিও।

সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে যেভাবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত বলেও মত তার।

“ইউরোপ, আমেরিকায় বিধিনিষেধ শিথিল হচ্ছে। আমি মনে করে, বিশ্বজুড়ে কী হচ্ছে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। সুরক্ষার বিষয়টিতে যে ছাড় দেওয়া উচিত নয়, তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে তাইওয়ান আর সিঙ্গাপুরের ঘটনা,” বলেছেন তিনি।