করোনাভাইরাস: টিকার পেটেন্ট শিথিল করতে চাপ বাড়ছে

ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকায় কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলায় করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং নিজ দলের ‘বামপন্থিদের’ চাপ বাড়ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2021, 04:30 PM
Updated : 5 May 2021, 04:30 PM

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে টিকার সরবরাহ বাড়াতে এই পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ আইন শিথিল করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে বাইডেনকে। 

ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এবং বায়োটেক কোম্পানিগুলোও এই চাপে রয়েছে। ভবিষ্যতে মুনাফা কমতে পারে এবং ব্যবসার ছক ভেঙে যেতে পারে- এমন আশঙ্কায় গত সোমবার এ ধরনের একটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। বিশ্বজুড়ে টিকার সরবরাহ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে টিকা উৎপাদনকারী দুটি বড় কোম্পানি ফাইজার ও মডার্না।

বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ পরিষদের সভাতেও এ বিষয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব চুক্তির কিছু অংশ শিথিল করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে চাপ দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাধা দিয়ে আসছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, হোয়াইট হাউজের ভেতরে, প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য উপদেষ্টারাও স্বীকার করেছেন যে, টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে বিভক্তি আছে।

একটি অংশ বলছে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি কেবল ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষ নিলে তা বাজে রাজনীতির নজির সৃষ্টি করবে।

আরেক অংশ বলছে, টিকা তৈরির কৌশল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সুরক্ষিত রাখা হয়, বিষয়গুলো যথেষ্ট জটিল। ফলে পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দিলেই টিকার বৈশ্বিক যোগান বাড়ানো যাবে না।

টিকা বানানোর প্রস্তুতপ্রণালী পেয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে, যে কোনো ওষুধ কোম্পানি তা দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারবে। বরং এ ধরনের পদক্ষেপ উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ শিল্পের ক্ষতি করবে।

এই পক্ষের মত হল, প্রেসিডেন্ট বাইডেন অন্যভাবেও বিশ্বের চাহিদার বিষয়টি সামলাতে পারেন, যেমন যেসব কোম্পানির কাছে এই টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বের মালিকানা রয়েছে, তাদের বাধ্য করতে পারেন, যাতে তারা আরও বেশি পরিমাণে টিকা উৎপাদন খরচেই বিক্রি করে অথবা অনুদান হিসেবে দেয়।

পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের নিয়ম শিথিলের দাবির বিপক্ষে মত দিয়ে বিনিয়োগ ব্যাংক এসভিবি লিরিংকের বিশ্লেষক জিওফ্রে পোরগেস বলেন, “ওষুধ শিল্প খাতের জন্য এমন সিদ্ধান্ত হবে ভয়ঙ্কর। এটা খুবই ক্ষতিকর হবে, কারণ শিল্প খাতের জন্য এটা এই বার্তা বহন করবে যে: ‘এমন কিছু নিয়ে কাজ করবেন না যেগুলোর বিষয়ে আমাদের আসলেই আগ্রহ আছে, কারণ যদি তা করেন, আমরা আপনাদের কাছ থেকে তা নিয়ে নেব।’”

বাইডেনের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান ড. অ্যান্থনি ফাউচি সোমবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ওষুধ উৎপাদকদের অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। হয় অন্যান্য দেশে ‘খুবই কম দামে’ টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে ধারাবাহিকভাবে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে, নয়ত তাদের প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল বিশ্ব সস্তায় তা তৈরি করতে পারে।

অবশ্য পেটেন্টের নিয়ম শিথিলের প্রস্তাবটি নিয়ে এখনও দ্বিধায় আছেন বলে জানিয়েছেন ফাউচি।

বাইডেনের এই উপদেষ্টা বলেন, “ব্যবসায় টিকে থাকতে কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে আমি সবসময় শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু শুধু স্বার্থ রক্ষা করার অজুহাতে প্রাণ রক্ষাকারী টিকা পাওয়ার সুযোগ থেকে জনগণকে, যাদের এটা দরকার, তাদের বঞ্চিত করতে পারি না। বিশ্বজুড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, কারণ তাদের টিকা পাওয়ার সুযোগ নেই, যেটা ধনীদের আছে- আপনি এ কাজ করতে পারেন না।” 

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বাইডেনের জন্য এই চুক্তি শিথিল করার আলোচনা একটি রাজনৈতিক এবং একইসঙ্গে একটি বাস্তব সমস্যা।

নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অবস্থায় তিনি উদারপন্থি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী অ্যাডি বারকানের কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথম করোনাভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি সেই প্রযুক্তি আটকে রাখবেন না। এখন সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিকল্পনা করেছেন, বুধবার ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মলে একটি সমাবেশে তারা প্রেসিডেন্টকে ওই প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেবেন।

ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো কিছু পেটেন্ট, ব্যবসায়িক গোপনীয়তা এবং ডব্লিউটিও-র ওষুধ উৎপাদনে মনোপোলি বা একক নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার বাণিজ্য-বিষয়ক মেধাস্বত্ব অধিকার বিষয়ক চুক্তি, যা টিআরআইপিএস হিসেবে পরিচিত, তা থেকে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এর উদ্দেশ্য হল, যেসব দেশ টিকা বানায় না, তাদেরও টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সস্তায় জেনেরিক কপি আমদানির সুযোগ করে দেওয়া।

এই প্রস্তাবের সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে, এসব বিষয়ে ছাড় দেওয়া হলে অন্য দেশগুলোর উদ্ভাবকরা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় করোনাভাইরাসের টিকা বানানোর চেষ্টা করবে, পেটেন্ট চুরির মামলার ভয় থাকবে না। আর ওই ছাড় কেবল করোনাভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এ সংক্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।

স্বাস্থ্যসেবা খাতের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনিশিয়েটিভ ফর মেডিসিনস, একসেস অ্যান্ড নলেজ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাহির আমিন বলনে, অনেকেই হয়ত প্রশ্ন করবেন যে শুধু মেধাস্বত্বে ছাড় দিলেই হবে, টিকা তৈরির গোপন কৌশল কি অন্য দেশের লাগবে না?

“এটা আসলে মূল বিষয় না। অনেক কোম্পানিই আছে, যারা মনে করে, তারা একাই কাজটি করতে পারবে, যদি তাদের পেছন ফিরে তাকাতে না হয় এবং এমন দোষারোপ করা না হয় যে তারা আরেকজনের মেধাস্বত্ব চুরি করে কাজ করছে।”

এর বিপরীতে ওষুধ শিল্প খাতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেধাস্বত্ব সুরক্ষার নিয়মটি শিথিল করলেই টিকার উৎপাদন বেড়ে যাবে- তা ঠিক না।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মানবদেহে টিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও অনেক বিষয় রয়েছে যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যার মধ্যে আছে, কাঁচামাল পাওয়ার সুযোগ এবং মাঠপর্যায়ে সরবরাহ সঙ্কট।

টিকা উৎপাদন করার অধিকার পাওয়ার মতই টিকার বিষয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার মত টিকা উদ্ভাবনকারী কোম্পানির আছে। সেজন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের কথাও এখানে আসছে।

ফাইজারের মুখপাত্র শ্যারন ক্যাসটিলো নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, তাদের কোম্পানির টিকা উৎপাদনের জন্য ১৯টি দেশের ৮৬টি সরবরাহকারীর মাধ্যমে ২৮০টি উপাদান দরকার হয়; এর জন্য উচ্চমানের বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি ও সুদক্ষ কর্মী, এবং ভবন দরকার এবং অংশীদার ও বৈশ্বিক সরবরাহকারী ও উৎপাদক নেটওয়ার্কের মধ্যে সময়-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হস্তান্তরও হতে হবে।

“আমরা মনে করি, এটা একটি অবাস্তব ধারণা যে চুক্তি শিথিল করলে টিকার উৎপাদন বাড়বে, বরং সরবরাহের সংকটগুলো এর চেয়ে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব।”

ফাইজারের প্রধান নির্বাহী অ্যালবার্ট বোরলা লিংকডইন-এ সোমবার বলেন, তার কোম্পানি ভারতে ৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ওষুধ জরুরি অনুদান হিসেবে দেবে। ভারতে এ টিকার দ্রুত অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টাও তারা অব্যাহত রাখছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তহবিল ব্যবহার করে টিকা উদ্ভাবনকারী কোম্পানি মডার্না অবশ্য এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, মহামারী মোকাবেলার উদ্দেশ্য নিয়ে যারা টিকা উৎপাদন করতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত পেটেন্ট দাবি নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ তারা জানাবে না।

তবে টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করার দাবির সমর্থকরা শুধু চুক্তি শিথিল করারই আহ্বান জানাচ্ছেন না, বরং তাদের দাবি, বাইডেন যেন টিকা উৎপাদনের কারখানা স্থাপন ও পরিচালনার বিষয়ে দক্ষতা বিনিময় করতে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করেন।

অলাভজনক বিভিন্ন সংস্থা মিলে গত মাসে এ ব্যাপারে ২০ লাখ মানুষের স্বাক্ষর করা একটি আবেদন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে জমা দেয়।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একদল সেনেটর, প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, প্রায় ১০০ সদস্য এবং ৭০ জন প্রাক্তন রাষ্ট্র প্রধান ও ১০০ জন নোবেল বিজয়ী একই আবেদন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বাইডেনের বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাই এ বিষয়ে একটি সমাধান বের করার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ২০টির বেশি বৈঠক করছেন অংশীজনদের সঙ্গে, যাদের মধ্যে আছেন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে কাজ করা কর্মীরা, ওষুধ কোম্পানির নির্বাহীরা, কংগ্রেসের সদস্য, ফাউচি এবং দাতব্য কার্যক্রমে যুক্ত বিল গেটস।

জাতিসংঘের বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার মহাপরিচালকের সঙ্গে পেটেন্ট শিথিল করার প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার পর টাইয়ের দপ্তর থেকে সোমবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, “মানুষের জীবন রক্ষা করা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে মহামারীর শেষ দেখার বিষয়টিতেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন।”

গত মাসে টাইয়ের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী- বায়োটেকনোলজি ইনোভেশন অরগানাইজেশন সতর্ক করে বলেছে, অন্যান্য দেশ, যাদের কেউ কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের লাইসেন্স দিয়ে দেওয়ার মানে হবে, মার্কিন ‘বিশ্বসেরা বায়োটেকনোলজির’ ভিত্তিকে ফাঁকা করে দেওয়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার উদ্যোমকে দমিয়ে দেওয়া।

ওষুধ শিল্পখাতের একটি ভয় হল, করোনাভাইরাসের টিকার জন্য এভাবে পেটেন্টের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হলে আরও অনেক ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের সুবিধাকে দুর্বল করার ক্ষেত্র তৈরি হবে- যা এসব ওষুধ কোম্পানির মুনাফা করার মূল চাবিকাঠি।