ভারতে টিকার জন্য ‘আগ্রাসী চাপ’, আদর পুনাওয়ালা তাই লন্ডনে

‘ওয়াই’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তায় সব সময় থাকছে ৪/৫ জন কমান্ডো, তবুও এখন ভারতে ফিরতে চাইছেন না আদর পুনাওয়ালা। করোনাভাইরাসের টিকা পেতে প্রভাবশালীদের ‘আগ্রাসী চাপ’ই এর প্রধান কারণ; বলছেন সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইনডিয়ার (এসআইআই)  প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2021, 07:27 PM
Updated : 1 May 2021, 07:39 PM

মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোভিড-১৯ টিকা পেতে কাড়াকাড়ির মধ্যে এখন আদর পুনাওয়ালাকে নিয়ে আলোচনা ভারতের সীমা ছাড়িয়েছে।

বিশ্বের ৬০ দেশে টিকা সরবরাহ করার চুক্তি রয়েছে তার কোম্পানি সেরামের, যারা কি না বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশেও তাদের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা নিচ্ছে। কিন্তু তাও ঠিকভাবে দিতে পারছে না তারা।

এরই মধ্যে ভারতে মহামারী পরিস্থিতি বিপর্যয়কর পর্যায়ে পৌঁছালে দেশটিতে টিকা পেতে আদর পুনাওয়ালার ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে তিনি পাড়ি জমান লন্ডনে। ২৩ এপ্রিল ভারতীয় নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই আদর পুনাওয়ালা ব্রিটেনে পৌঁছান বলে দ্য টাইমসের খবরে উল্লেখ করা হয়।

ব্রিটিশ এই দৈনিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেই ৪০ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী টিকা পেতে মরিয়া ক্ষমতাশালীদের চাপের কথা তুলে ধরেন, যা ভারতের গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।

তার ভাষায়, সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। লন্ডনে থেকেও তিনি ফোন কল পাচ্ছেন। ‘আগ্রাসী’ চাপের কারণেই মূলত তিনি লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখন স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে সেখানেই রয়েছেন।

এসআইআই প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা বলেন, “আমি এখানে থাকার সময় বাড়িয়েছি। কেননা আগের সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাই না। সবকিছুই যেন আমার উপর …. অথচ আমি একা কী করতে পারি। আমি এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না, যেখানে আমি চেষ্টা করে যাব, কিন্তু এক্স, ওয়াই বা জেডকে (টিকা) দিতে না পারার জন্য তারা কী যে করে ফেলতে পারে, সেটা বুঝতেও পারব না।”

এক ধরনের ভীতির কথা তুলে ধরে তিনি লন্ডনে বসেও ‘আগ্রাসী’ ফোন কল পাওয়ার কথা জানান।

সাক্ষাৎকারে আদর পুনাওয়ালা বলেন, দেশে থাকা অবস্থায় ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশীল কিছু ব্যক্তিরা টিকে পেতে তাকে চাপ দিচ্ছিলেন। 

মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার পর বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশটিতে প্রতিনিয়ত টিকার জন্য চাপ বাড়ছে।

‘মুমূর্ষু’ ভারতের অনেক রাজ্যেই এখন টিকার মজুদ নেই। মুম্বাইসহ অনেক রাজ্যে টিকাদান কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়াও হয়েছে।

অন্যদিকে অক্সিজেনের অভাবে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে দিল্লিতে। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ঠাঁই নেই পরিস্থিতি।

সেরামের তৈরি কোভিশিল্ড

এমন পরিস্থিতিতে সেরাম ইন্সটিটিউটের উপর টিকা সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর চাপও বাড়তে থাকার কথা জানান পুনাওয়ালা।

কতটা চাপে আছেন তা বোঝাতে গিয়েই তিনি বলেন, তার নিরাপত্তার জন্য ভারত সরকার ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। অথচ তিনি ফিরতে চাইছেন না।

ভারত সরকার চলতি সপ্তাহে সম্ভাব্য হুমকির প্রেক্ষাপটে পুনাওয়ালা যেখানেই যাবেন ‘ওয়াই’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পাবেন বলে জানিয়েছে। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) সশস্ত্র ৪ থেকে ৫ জন কমান্ডো সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে থাকবেন।

টিকার জন্য প্রত্যাশা ও আগ্রাসী চাপের বিষয়টি অকল্পনীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা খবুই অবিশ্বাস্য। সবাই মনে করছেন তার টিকা পেতে হবে। তারা বুঝতেই চাইছেন না তাদের আগেও কেউ এটি পেতে পারেন।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি অবশ্য বলেন, চাপ ছাড়াও ব্যবসায়িক কারণেও তিনি লন্ডনে এসেছেন এবং থাকার সময় বাড়িয়েছেন।

ভারতের বাইরেও টিকা উৎপাদনের কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও আরেকটি কারণ বলে তিনি জানান।

টিকা তৈরির অন্য দেশের তালিকায় যুক্তরাজ্যও রয়েছে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এই বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।

ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের জন্য ‘দায়িত্ববোধ’ থাকার কথা জানিয়ে পুনাওয়ালা বলেন, “এর আগে কখনই জীবন বাঁচানোর এমন যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে আমাদের টিকা বানাতে হয়নি। তাই আমরা যা পারছি সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

কোভিশিল্ড টিকার দাম বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করার অভিযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ ‘ভুল’ দাবি করে তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর পরও এটি বিশ্বের সবচেয়ে সহজলভ্য টিকা হবে।

আদর পুনাওয়ালা। ছবি: রয়টার্স

“আমরা সবচেয়ে ভালো চেষ্টাই করেছি। ইতিহাস যে বিচার করবে সেই সময়ের জন্য আমি অপেক্ষা করব।“

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের উদ্ভাবিত যে টিকা ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা বাজারজাত করছে, সেটাই তৈরি করছে সেরাম।

জুলাইয়ের মধ্যে তারা টিকা উৎপাদন মাসে ১০ কোটি ডোজে উন্নীত করতে পারবে বলে গত সপ্তাহেই জানিয়েছিলেন পুনাওয়ালা।

এর আগে উৎপাদন বাড়াতে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত একটি সময়সীমা জানানো হয়েছিল।

ছয় মাসের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টিকা উৎপাদন সক্ষমতা ২৫০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি পর্যন্ত বাড়ানো যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে গত বছরের নভেম্বরে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ওই টিকা সরবরাহের দায়িত্বে আছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।

চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ দেশে এলেও বিপুল চাহিদা আর বিশ্বজুড়ে টিকার সঙ্কটের মধ্যে ফেব্রুয়ারির চালানে বাংলাদেশ ২০ লাখ ডোজ হাতে পায়। এরপর আর কেনা টিকা আর আসেনি।

নিজেদের বিশাল জনগোষ্ঠীর টিকাদান নিশ্চিতে ভারত টিকা রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আর সেই কারণেই দেওয়া যাচ্ছে না বলে বাংলাদেশকে জানিয়েছে সেরাম।