কোভিড: শরীর সারার পর মন বাঁচানোর লড়াই

“মনে হত গভীর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ব্যাখ্যা করে বোঝানোর মত না। তবে পরিস্থিতিটা খুব ভীতিকর। খাদের নিচে কিংবা অন্ধকার কূপের নিচে চলে যাচ্ছি- এরকম অনুভূতি তৈরি হত।”

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2021, 07:55 PM
Updated : 1 May 2021, 08:25 AM

গত মার্চে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি এমন মানসিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে গেছেন ঢাকার পুস্তক সম্পাদক মনোজ দে।

ভয়ের ওই বিচিত্র অনুভূতিগুলো তার মাথায় উঁকি দিতে শুরু করে আক্রান্ত হওয়ার অষ্টম দিন থেকে। ‘অতলে ডুবে যাওয়ার’ ভয় তাকে চেপে ধরতে থাকে।

আদর্শ প্রকাশনীর সম্পাদক মনোজ ভাইরাসমুক্ত হয়েছিলেন সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৮ দিন পর। জ্বর, গলাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি মিললেও ভয় আর অস্থিরতা কাটাতে তাকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছে।

৩৭ বছর বয়সী মনোজের মত কোভিড থেকে সুস্থ হওয়া অনেকেই নতুন কিছু জটিলতায় ভুগছেন, যা তাদের ‘আগে ছিল না’। এর কিছু শারীরিক, কিছু আবার মানসিক। বিষয়গুলো তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রেও জটিলতা বাড়াচ্ছে।

বিশ্বজুড়েই কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মনস্তাত্ত্বিক ও স্নায়বিক জটিলতায় ভোগার চিত্র উঠে আসছে বিভিন্ন গবেষণায়।

নভেম্বরে ল্যানসেটের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, সুস্থ হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের বেশিরভাগের মধ্যেই উদ্বেগ, অনিদ্রা ও হতাশা দেখা যায়; যা পরে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

গত সেপ্টেম্বর থেকে দুই দফা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন একটি বায়িং হাউজের কর্মী মোহাইমিনুল আহমেদ। শরীর সেরে উঠলেও মেজাজ প্রায়ই আর নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আবার ভুলে যাওয়া, ঘুম না হওয়া এবং দুঃস্বপ্নের মত সমস্যাও তার হচ্ছে।

“২ থেকে ৩ ঘণ্টা শুয়ে থাকলেও দেখা যায় ঘুম আসতে চায় না। আবার যখন আসে, সঙ্গে দুঃস্বপ্ন নিয়ে আসে। আতঙ্কে লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠি।”

ত্রিশের তরুণ মোহাইমিনুল জানালেন, দ্বিতীয় দফা আক্রান্ত হওয়ার পর খুব ছোটখাটো বিষয়েও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেজাজ হারাচ্ছেন তিনি। তার সঙ্গে সাধারণ জিনিসগুলোও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে অনেক।

“ফোকাস করতে পারছি না, মনে রাখতে পারছি না। ফ্যামিলির সবাই বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা হল, দশ মিনিট পর আমার স্ত্রী যখন সেটা নিয়ে কিছু বললো, তখন দেখা যায় আমি পাল্টা প্রশ্ন করছি, এ নিয়ে কখন কথা বললাম! মেমোরিতে থাকছে না।”

৬২ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ রোগীসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে গবেষকরা দেখেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ লাখের বেশি কোভিড রোগীর চিকিৎসা নথি পর্যালোচনা করে আক্রান্তদের মধ্যে উদ্বেগ এবং ভাবের ভারসাম্যহীনতা দেখেছেন সবচেয়ে বেশি।

গত অক্টোবরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি কর্মজীবী হোস্টেলে অনেকটা বন্দিদশায় কাটাতে হয়েছিল বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে মিথিলা নাজনীনকে। তাকেও পরে এ ধরনের মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।

“একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে অন্য প্রসঙ্গে চল যাই। কোথা থেকে শুরু করছিলাম, কোথায় থামতে হবে, কোনো কিছুই মাথায় থাকে না। চার-পাঁচ লাইনের লেখা বুঝতেও গোলমাল লেগে যায়।”

ভুলে যাওয়ার সমস্যা চাকরির ক্ষেত্রে বাড়তি মানসিক চাপে ফেলছে মিথিলাকে। সেই সঙ্গে একটুতেই মন খারাপ হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে থাকা, রেগে যাওয়া, কারও সাথে কথা বলা বা মেশার ইচ্ছে না করার মত বাড়তি সমস্যা ভোগাচ্ছে তাকে।

“এটা শুধু শারীরিক না, এটা মানসিক অসুখও দিয়েছে। কারও সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না, নিজের মধ্যে থাকা হয়। ওই প্যানিকড অবস্থাটা থেকে বের হতে অনেক সময় লাগে।”

গবেষকরা বলছেন, খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চাপ থেকেও অনেকের এরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।

এছাড়া কোভিড-১৯ মানুষকে যে শারীরিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দেয়, তার ফলাফল হিসেবে স্ট্রোক ও স্মৃতিভ্রংশের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

কোভিড থেকে সেরে ওঠা বেশ কয়েকজন রোগীকে মানসিক সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহজাবীন হক বলেন, “এটার সাথে মৃত্যুভয় জড়িত থাকে, ওই আশঙ্কাটা তাদের মধ্যে থেকেই যায়।

“সাথে শারীরিক দুর্বলতার প্রভাবও জড়িত আছে। এসব কারণে তারা ডিপ্রেসড থাকে; মন ভালো থাকে না, ভয় লাগে। সিভিয়ার ডিপ্রেশন থেকে হ্যালুসিনেশনও হয়ে থাকে।”

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের তরুণী গৃহিনী ইসরাত জাহান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন প্রায় পাঁচ মাস। ভাইরাস থেকে মুক্তি হলেও আতঙ্ক থাকে ছাড়েনি।

“রাতে ভীষণ ভয় পাই। পাশে কেউ থাকলেও ভয় কাজ করে, যেটা আগে ছিল না। মনে হয় অশরীরী কিছু রুমের মধ্যে আছে। সেটা এসে কোনো ক্ষতি করবে। এই ভয়ে ঘুম থেকে উঠে যাই। অনেক বেশি দুঃস্বপ্ন দেখি।“

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, যে কোনো ভাইরাল সংক্রমণের ভোগান্তির পর কষ্ট থেকে ‘মানসিক বিপর্যয়’ তৈরি হতে পারে।

“আমাদের দেশে এ নিয়ে কোনো গবেষণা এখনও হয়নি। তবে আমার ধারণা, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকেরই ডিপ্রেশন ডেভেলপ করে।“

তরুণ ব্যবসায়ী শাওয়াল উজ্জ্বল পাঁচ মাস ধরেই এ ধরনের সমস্যায় রয়েছেন। গত নভেম্বরে মা ও স্ত্রীসহ সংক্রমিত হওয়া উজ্জ্বল জানান, তার মায়েরও ভুলে যাওয়ার সমস্যাটা হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কোভিড থেকে সেরে ওঠা ৩৫ থেকে ৩৭ শতাংশ রোগীর মধ্যে স্নায়বিক জটিলতা দেখা যাচ্ছে।

“কোভিডের পরেই যে নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা হচ্ছে, সেটা অনেকে বুঝতে পারেন না। তবে যারা সমস্যা নিয়ে আসছেন, তাদের কাছে জেনে আমরা বুঝতে পারছি, কোভিডের কারণেই তাদের এটা হচ্ছে।”

তিনি জানান, এ ধরনের রোগীরা মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, শরীর ব্যথা, হাত-পা ঝিনঝিন করা, শরীর অবশ লাগা, ভুলে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা, জ্বর জ্বর ভাব, গন্ধ না পাওয়ার জটিলতার কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলোজি বিভাগের অধ্যাপক কনোজ কুমার বর্মণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক দিন আগে স্ট্রোকের একজন রোগী পেয়েছি, বিভিন্ন ইনভেস্টিগেশন করে দেখা গেল, উনি কোভিডের পেশেন্ট ছিলেন।”

কোভিড থেকে সেরে ওঠাদের এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোকাবেলার করে ভালো থাকার জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ ও শরীরচর্চার পাশাপাশি বেশকিছু কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

অধ্যাপক কনোজ বলেন, “কোভিড থেকে ভালো হয়ে বাসায় যাওয়ার পরে সেই রোগীকে সাবধানে থাকতে হবে; বিশ্রামে থাকতে হবে।

“ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর পরেও অনেকের স্ট্রোক হয়ে যায়। তেমন হলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।”

কোভিডে আক্রান্তরা শারীরিক সুস্থতায় যতটা গুরুত্ব দেন, মানসিক বিষয়ে ততটা নজর দেন না বলে মনে করেন অধ্যাপক মাহজাবীন হক।

তিনি বলেন, “একটু একটু করে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে। ভালো লাগার কাজগুলো করে, পছন্দের গান শুনে ভালো লাগার স্মৃতিগুলো মনে করে, যত ভালো কিছু তার সাথে হয়েছে, সেসব ছবির অ্যালবাম সে দেখতে পারে।”

ভয়-আতঙ্ক অনেক বেশি হয়ে গেলে, নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুস সালাম।

আর কোভিডজয়ী মনোজ দে জানালেন, তিন সপ্তাহের অনবরত চেষ্টায় ভয় পাওয়ার সমস্যা তিনি একটু একটু করে কাটিয়ে উঠেছেন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ইউটিউব দেখে ও বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করেছি। নিজে নিজে মেডিটেশন করেছি।

“ইয়োগা, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করেছি। এরপর মানসিক স্বস্তি এসেছে। এখন আর ভয়টা নেই, তবে ঘুম কম হচ্ছে।”

বিকল্প কৌশল করে ভুলে যাওয়ার জটিলতা এড়ানোর কথ বললেন কোভিড থেকে সুস্থ হওয়া রফিকুল বাশারও।

৪৫ বছর বয়সী এই গণমাধ্যমকর্মী বললেন, “এখন কাজগুলো লিখে রাখতে হচ্ছে, যাতে মনোযোগ অন্যদিকে না যায়।”