তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তা সামাল দেওয়ার মতো অক্সিজেন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে।
তবে পরিস্থিতি যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তবে যে এই অক্সিজেন দিয়ে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে, তাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তারা।
নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের একটি অংশের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় কিংবা দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। তখন রোগীকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন না দিলে দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
ভারতের নয়া দিল্লিতে দেখা দিয়েছে এখন সেই অবস্থা। অক্সিজেন না পেয়ে সেখানে রোগীদের মারা যেতে হচ্ছে,যা বিশ্বজুড়েই উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।
দেশে চাহিদা এখন কত?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এপ্রিলের শুরুতে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে গেলেও এখন তা কমে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন মিঞা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কায় দৈনিক অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টনে। রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমায় এখন হাসপাতালগুলোতে ১৪০ থেকে ১৫০ টনের মতো অক্সিজেন লাগছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ে ১০০-১২০ টনের মতো অক্সিজেনের চাহিদা থাকে। এই চাহিদা পূরণ হয় দেশের উৎপাদনেই।
লিন্ডে বাংলাদেশ ৯০ টন ও স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড ২০-৩০ টন অক্সিজেন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে থাকে। ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড বেসরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিছু পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের মতো বাংলাদেশেও এপ্রিলের শুরুতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। দিনে ৭ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের রেকর্ডও তখনই হয়েছিল।
তবে এরপর সরকার লকডাউন দিলে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন হাজারের ঘরে নেমে আসে।
ঢাকার হাসপাতালগুলোতেই কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেশি। আর এই হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চের শেষ দিক থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি অক্সিজেনের যে চাহিদা ছিল, রোগী কমে আসায় সেই চাহিদা এখন কিছুটা কমেছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোগী ভর্তির পরিমাণ এখন কমে গেছে। এটা ভালো লক্ষণ। এখন পর্যন্ত কোনো সঙ্কট হয়নি অক্সিজেনের।”
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এখন ১৭০ থেকে ১৮০টি শয্যা খালি থাকছে জানিয়ে এর পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অক্সিজেনের চাহিদা বেশি ছিল। গত এক সপ্তাহে আমাদের রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সে হিসেবে অক্সিজেনের চাহিদা কমে গেছে। এখন আমাদের যতটুকু অক্সিজেন দরকার, ততটুকু পাচ্ছি। বর্তমান উৎপাদন দিয়েই চলছে।”
ভারত থেকে আসছে না, প্রভাব পড়ছে কী?
ভারত থেকে নিয়মিতই অক্সিজেন আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যে ১৩ এপ্রিল বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বেড়েছিল। ২১ এপ্রিল আমদানি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে চারটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন আমদানি করেছিল।
ভারতের কোভিড পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় কবে নাগাদ আবার অক্সিজেন আমদানি করা যাবে, তা অনিশ্চিত। তবে দেশে রোগী কমে যাওয়ায় আমদানি বন্ধের ফলে ধাক্কা লাগবে না বলে মনে করছে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অবশ্য তবে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিল্পকারখানার অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়েছে দেশের বেশিরভাগ অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশকে।
প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান সাইকা মাজেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ছয় থেকে সাত সপ্তাহে অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বাড়ায় দৈনিক উৎপাদিত ৯০ টনের পুরোটাই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দিতে হচ্ছে।
“এতে ইন্ডাস্ট্রি সাফার করছে, কিন্তু আসলে কিছু করার নাই। মেডিকেল আগে প্রায়োরিটি,” বলেন তিনি।
বর্তমান চাহিদা মেটানো যাচ্ছে জানিয়ে সাইকা মাজেদ বলেন, “এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে চলে যাচ্ছে।”
চাহিদা কমেছে বলে এখন তা মেটানো যাচ্ছে বলে জানান ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ, যারা ৩০ টনের মতো অক্সিজেন হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন আমাদের যে উৎপাদন হচ্ছে, সেটা দিয়ে চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে। আমরা ৩০ টনের মতো অক্সিজেন হাসপাতালগুলোতে দিচ্ছি। আমাদের সক্ষমতা আছে ৪০ টনের।”
ইসলাম অক্সিজেন প্রায় ১০ বছর ধরে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করছে। এবারই প্রথম তাদের আমদানি বন্ধ হল। তারা নিজেরা দেশে উৎপাদন করে ৩০-৩২ টনের মত। কিছু অক্সিজেন শিল্পেও দেয় তারা, তবে মহামারীকালে আমদানি বন্ধ হওয়ায় এখন শুধু চিকিৎসা সেবাতেই দিচ্ছে।
সঙ্কটের আশঙ্কা কতটা?
এখন চাহিদা কমলেও পরিস্থিতি যদি আবার এপ্রিলের শুরুর মতো হয়, তবে যে সঙ্কট হবে, তা বলছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।
মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, “মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যে রকমভাবে রোগী বেড়েছে, তেমন যদি রোগী হয়, তাহলে অক্সিজেন সঙ্কট হওয়ার কথা না। তবে এর চেয়ে যদি বেশি রোগী বাড়ে, তবে সঙ্কট হবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ মিঞা বলেন, “সংক্রমণ যদি অনেক বেড়ে যায়, তখন হয়ত সঙ্কট দেখা দিতে পারে।”
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশের সাইকা মাজেদও বলেন, পরিস্থিতি খারাপ হলে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ রোগী বাড়লে অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।
ইসলাম অক্সিজেনের মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, “যখন চাহিদা বেশি ছিল, তখন আমরা ১৫ থেকে ২০ টন অক্সিজেন আমদানি করতাম ভারত থেকে। এটা বন্ধ থাকলে, আর সংক্রমণ বেড়ে গেলে, তখন অবশ্যই অক্সিজেনের সঙ্কট দেখা দেবে।”
গত ১২ এপ্রিল দেশে সক্রিয় রোগী এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সংক্রমণ কিছুটা কমায় এখন তা নেমে এসেছে ৭৬ হাজারের ঘরে।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, সারাদেশে হাসপাতালে ভোভিড-১৯ রোগীদের ১২ হাজার ২৯৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ৭ হাজার ৪৮৮টি। ১ হাজার ৬৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ৩৮৪টি।
লকডাউনের পরিস্থিতির উন্নতি দেখে ২৮ এপ্রিলের পর আরও এক সপ্তাহ তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে এর মধ্যে দোকান-পাট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীনতাও দৃশ্যমাণ।
তা দেখে ফেইসবুকে অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন- ‘ভারতের মত উন্নত চিকিৎসার দেশের পরিণতি দেখেও আপনাদের হুঁশ হয় না!’
সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ এলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে, তা মনে দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও দুদিন আগে বলেছিলেন, “এই যে আমরা ঘোরাঘুরি করি বেসামালভাবে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় গেলাম, মাস্ক পরলাম না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলাম না। এই কারণে দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। একই কাজ যদি আমরা আবার করি তাহলে তৃতীয় ঢেউ আবার আসবে।”
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই রকম পরিস্থিতি যেন না হয়, সেজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সচেতন হতে হবে। তার কোনো বিকল্প নেই।
পরিস্থিতি সামালে পরিকল্পনা কী?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ মিঞা বলছেন, পরিস্থিতির অবনতি হলেও যেন চাহিদা মতো অক্সিজেন পাওয়া যায়, সেজন্য এখনই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
কী প্রস্তুতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিভিন্ন অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সারাদিনই আমরা মিটিং করছি। ছোট ছোট কোম্পানিকে আমরা উৎপাদন বাড়াতে বলেছি। তাদের কোনো শিল্প কারখানার জন্য উৎপাদন না করে মেডিকেলের জন্য অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলেছি আমরা।”
লিন্ডে বাংলাদেশের কর্মকর্তা সাইকা মাজেদ বলেন, সরকার চাইলে আমদানির প্রস্তুতিও তাদের রয়েছে।
“সরকারকে আমরা সবকিছু জানিয়েছি। আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা কতটুকু, আমরা কতটা পারব। পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অক্সিজেন আনতে খরচ হয়ত দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সরকার যদি বলে আমাদের নিয়ে আসতে, আমরা আনতে পারব। আমাদের সেই সক্ষমতা আছে।”