কোভিড-১৯: টিকার দৌড়ে কোন দেশ কোথায়

করোনাভাইরাসের টিকার কথা এলেই সবার আগে যে প্রশ্নটি বেশিরভাগ মানুষ করবে, তা হল- ‘আমি কবে টিকা পাব’। এখন পর্যন্ত কয়েকটি মাত্র দেশ তাদের অধিকাংশ নাগরিককে টিকার আওতায় আনার সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য ঠিক করতে পেরেছে। বাকি বিশ্বের পরিস্থিতি এখনও স্পষ্ট নয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2021, 07:06 PM
Updated : 13 Feb 2021, 05:06 AM

বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে টিকা দিতে না পারলে করোনাভাইরাসকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না। আর সেজন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি বহুপক্ষীয় সহযোগিতার আলোচনা যেমন চলছে, তেমনি আগে টিকা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশ অন্তরালেও সক্রিয়।    

ফলে বিশ্বের সবাইকে কবে নাগাদ টিকার আওতায় আনা সম্ভব, সেটা এখনই বোঝা কঠিন বলে মন্তব্য করা হয়েছে বিবিসির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে। 

ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের পরিচালক আগাথা ডেমারাইসের নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছে।

বিশ্বের টিকা উৎপাদন সক্ষমতা, টিকা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা, এ পর্যন্ত কোন দেশ কত লোককে টিকা দিয়েছে এবং কোন দেশের টিকা কেনার সামর্থ্য কেমন- এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ওই গবেষণায়।

ফল যা পাওয়া গেছে, তাতে ভ্যাকসিন দৌড়ে ধনী ও গরিব দেশগুলোর পার্থক্যটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। 

তাদের পূর্বাভাস ঠিক হলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশ ২০২১ সালের মধ্যে সবাইকে টিকা দিতে পারবে। রাশিয়া, কানাডা, দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ দেশ ও অস্ট্রেলিয়া হয়ত ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

ভারত, চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ২০২২ সালের শেষভাগে জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশকে টিকা দিতে পারবে। বাংলাদেশ, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশকে ২০২৩ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।  

বিবিসি লিখেছে, এখন পর্র্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের জন্য টিকার পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছে, কারণ টিকা তৈরির এর পেছনে বিপুল টাকা বিনিয়োগ করার সামর্থ্য তাদের আছে। এ বিষয়টিই তাদের নিয়ে গেছে একেবারে সামনের কাতারে। 

কানাডা এবং ইউরোপের অন্য যে ধনী দেশগুলো টিকা তৈরির জন্য ততটা মনোযোগ দেয়নি, তারা সামান্য পিছিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তুলনায়।

পুরো দেশের জন্য যা প্রয়োজন, তার পাঁচগুণ টিকা কেনার খবরে গতবছরের শেষ দিকে কানাডাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আগের সরবরাহ পাওয়ার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করতে পারেনি।

বিবিসি লিখেছে, কানাডার পিছিয়ে পড়ার একটি কারণ হল, টিকার জন্য তারা নির্ভর করেছে মূলত ইউরোপীয় কারখানাগুলোর ওপর। তাদের ভয় ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প হয়ত টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। ঝুঁকি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গেই তারা চুক্তি করেছে।

কিন্তু সেই বাজিতে কানাডার লাভ হয়নি, বরং ঝুঁকি বেড়েছে। ইউরোপীয় ভ্যাকসিন প্ল্যান্টগুলো সরবরাহ করতে গিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নই এখন রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিচ্ছে।

আগাথা ডেমারাইস বলেন, ইউরোপের দেশগুলো যতক্ষণ না যথেষ্ট টিকা পাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কানাডার চাহিদা মেটানোর বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পাবে না বলেই তার মনে হচ্ছে।

ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা বলছে, নিম্ন আয়ের অধিকাংশ দেশ এখনও নাগরিকদের টিকাদান শুরু করতে পারেনি। তবে কিছু দেশ প্রত্যাশার তুলনায় এগিয়ে গেছে।

জনসংখ্যার তুলনায় টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে সার্বিয়ার অবস্থান এখন অষ্টম; ইউরোপের যে কোনো দেশের চেয়ে তারা এ দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে। 

বিবিসি লিখেছে, সার্বিয়ার এই সাফল্যের মূলে রয়েছে দক্ষতার সঙ্গে তাদের টিকাদান শুরু করতে পারার বিষয়টি। তাছাড়া পূর্ব ইউরোপে টিকা বিক্রি নিয়ে রাশিয়া ও চীনের প্রতিযোগিতা থেকেও তারা লাভবান হয়েছে। সার্বিয়া সেই গুটিকয় দেশের একটি, যেখানে রাশিয়ার স্পুৎনিক ভির পাশাপাশি চীনের সিনোফার্মের টিকাও দেওয়া হচ্ছে।

নাগরিকদের টিকা দেওয়ার জন্য যে ফরম সার্বিয়া তৈরি করেছে, সেখানে ফাইজার, স্পুৎনিক ও সিনোফার্ম থেকে যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকছে। তবে সেখানে চীনা টিকা নিয়েই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বেশি।

তাতে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পাচ্ছে সিনোফার্ম। যেসব দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজে তাদের টিকা দেওয়া হচ্ছে, পরবর্তী বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হলে সেটাও সিনোফার্ম থেকেই তাদের কিনতে হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতও অনেকাংশে নির্ভর করছে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের ওপর। এখন তারা নাগরিকদের যে টিকা দিচ্ছে, তার ৮০ শতাংশ ওই চীনা কোম্পানির। আমিরাতে সিনোফার্মার একটি টিকা উৎপাদন কেন্দ্রও তৈরি হচ্ছে।

চীন ও ভারত টিকার ক্ষেত্রে রীতিমত পরাশক্তি হয়ে উঠলেও নিজেদের বিপুল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ অংশকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা তাদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পূর্বাভাস ঠিক হলে চীন বা ভারত ২০২২ সালের শেষভাগের আগে নিজেদের যথেষ্ট সংখ্যক নাগরিককে টিকা দেওয়া শেষ করতে পারবে না।

এর বড় কারণ দুই দেশের বিশাল জনসংখ্যা। দুই দেশেই ১৩০ কোটির বেশি মানুষের বসবাস, সেই অনুপাতে যথেষ্ট সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীরাও অভাব আছে।

টিকা উৎপাদক হিসেবে ভারতের সাফল্যের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়া। গত জানুয়ারি মাসেই তারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ শুরু করেছে। এখন সেখানে প্রতিদিন ২৪ লাখ ডোজ টিকা তৈরি হচ্ছে।

কেবল ভারত সরকারকে নয়, ব্রাজিল, মরক্কো, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও টিকা সরবরাহ করছে সেরাম ইনস্টিটিউট।

এ প্রতিষ্ঠানের সিইও আদর পূনাওয়ালা বলেন, “টিকা উৎপাদন শুরুর পর আমি ভেবেছিলাম, এখন বোধ চাপ আর টিকার জন্য পাগলামি কিছুটা কমবে। কিন্তু এখন সবাইকে খুশি রাখাটাই হয়ে গেছে বড় চ্যালেঞ্জ। 

“আমি ধারণা করেছিলাম, অন্য যারা উৎপাদক আছে, তারাও পর্যাপ্ত সরবরাহ শুরু করে দিতে পারবে। কিন্তু দুঃখজন হল, বছরের এই প্রথম প্রান্তিকে, এমনকি দ্বিতীয় প্রান্তিকেও হয়ত বিশ্বে টিকা সরবরাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা দেখতে পাব না।”

পূনাওয়ালা বলেন, উৎপাদন রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলা আসলে সম্ভব না, সেজন্য সময় লাগে।

“অনেকে মনে করেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের হাতে হয়ত ম্যাজিক সস আছে। হ্যাঁ, আমাদের যে কাজ সেটা আমরা ভালোভাবেই করতে পারি, কিন্তু কোনো জাদুদণ্ড আসলে আমাদের হাতে নেই।”

তিনি জানান, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গতবছরের মার্চে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, আর প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ও কাচের ভায়াল মজুদ করা শুরু করেছিলেন গত অগাস্টে। 

ফলে এখন যারা টিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেবেন, তাদের আসলে উৎপাদন শুরু করতে বহু মাস লেগে যাবে। আর করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর বুস্টার তৈরি করার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

পূনাওয়ালা জানান, কোভ্যাক্সের অধীনেও ভারত ও আফ্রিকায় টিকা সরবরাহ করতে সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিশ্বজুড়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোও যাতে টিকা পায়, তা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্যাভির নেতৃত্বে কোভ্যাক্স নামের এই প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। যেসব দেশের টিকা কেনার সামর্থ্য নেই তারা বিশেষ তহবিলের আওতায় কোভ্যাক্স থেকে বিনামূল্যে টিকা পাবে মোট জনসংখ্যার একটি অংশের জন্য। বাকিদের টিকা কিনে নিতে হবে। 

ঢাকার বিএসএমএমইউর টিকাদান কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা হাতে এক নার্স । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কোভ্যাক্সের অধীনে এ মাস থেকেই টিকা সরবরাহ শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত দেশগুলো আবার নিজেরাও আলাদাভাবে টিকা কেনার দর কষাকষিতে রয়েছে।

বিবিসিকে পূনাওয়ালা বলেছেন, আফ্রিকার প্রায় সবগুলো দেশ টিকার জন্য আলাদাভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। 

গত সপ্তাহে উগান্ডা ঘোষণা দেয়, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৭ ডলার দরে ১ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা কিনছে তারা। অথচ কোভ্যাক্স একই টিকা নিচ্ছে ৪ ডলার দরে।

সেরাম ইনস্টিটিউট বলেছে, উগান্ডার সঙ্গে তাদের আলোচনা চললেও এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। আর কোভ্যাক্সকে তাদের এখন ২০ কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার কথা। ভবিষ্যতে এ টিকার আরও ৯০ কোটি ডোজ কোভ্যাক্সকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।  

তবে কোভ্যাক্স তাদের লক্ষ্য কতটা পূরণ করতে পারবে, সে বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের আগাথা ডেমারাইস।

কবে কোথায় কত টিকা সরবরাহ করা হবে, সেই সূচি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি কোভ্যাক্স। দি পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু করাও যায়, তারপরও চলতি বছরের মধ্যে কোভ্যাক্সের সদস্য দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ২০-২৭ শতাংশকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে।

ডেমারাইসের ভাষায়, তাতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে খুব সামন্যই। তার ধারণা, কিছু দেশ ২০২৩ সালেও জনসংখ্যার বড় অংশকে টিকার আওতায় আনতে পারবে না। কিছু দেশ থাকবে যেখানে কখনোই সব মানুষ টিকা পাবে না। 

যেসব দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, বা যেসব দেশে সংক্রমণ আর সেভাবে হচ্ছে না, স্বাভাবিকভাবেই টিকা প্রয়োগকে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে না।

মুশকিল হল, বিশ্বের কোথাও যদি করোনাভাইরাস টিকে থাকে, তাহলে সেটি আবারও ছড়িয়ে পড়ার এবং নিজেকে বদলে নেওয়ার সুযোগ পাবে।

বিবিসি লিখেছে, টিকা তৈরির গতি এখন বেড়েছে, কিন্তু ৭৮০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে সবাইকে, অথবা একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে টিকা দেওয়া এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। এরকম কোনো চেষ্টা এর আগে মানুষকে করতে হয়নি।