কোভিড-১৯: নার্স রুনুর জয় বাংলা ধ্বনিতে বাংলাদেশে টিকাযজ্ঞ শুরু

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বহু প্রতীক্ষিত টিকাদান কার্যক্রম শুরু হল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2021, 10:26 AM
Updated : 15 Feb 2021, 03:32 AM

মহামারীতে মৃত্যু, শোক আর সঙ্কটের একটি বছর পেরিয়ে এসে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়েই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে সরকার আশা করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এই টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রথম পাঁচজনকে টিকা দেওয়া দেখেন তিনি।

প্রথম টিকা দেওয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে। টিকা নিয়ে তিনি বলেন ‘জয় বাংলা’। প্রধানমন্ত্রীও তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান।

এরপর একে একে টিকা নেন এ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহমেদ লুৎফুল মোবেন, স্বাস্থ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, মতিঝিল বিভাগের ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মো. দিদারুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদ।

বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে উচ্ছ্বসিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। টিকা নিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুললে গণভবন প্রান্ত থেকে তাতে কণ্ঠ মেলান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ছবি: পিএমও

টিকাদান শুরুর আগে দেওয়া বক্তব্যে সরকারপ্রধান বলেন, “আমি বলব এটা একটা ঐতিহাসিক দিন। কারণ বিশ্বের অনেক দেশ এখনও শুরু করতে পারেনি। সেখানে আমাদের মত একটি দেশ, ঘনবসতিপূর্ণ দেশ… সীমিত অর্থনৈতিক শক্তি নিয়েই আমরা কিন্তু মানুষের কল্যাণে যে আমরা কাজ করি সেটাই আজকে প্রমাণ হল।” 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, টিকা আসা শুরু হয়েছে, আরও আসবে। এরপর সারা দেশে টিকা দেওয়া শুরু হবে, যাতে দেশের মানুষ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পায়।

প্রথম দিন সব মিলিয়ে মোট ২৬ জনকে টিকা দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে, সে প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে সেরে ফেলা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে টিকা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বুথ তৈরি করা হয়েছে।

এছাড়া টিকা প্রয়োগের পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও কারো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে হাসপাতালগুলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা, যা ‘নিরাপদ এবং অধিকাংশের ক্ষেত্রে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে’ বলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে। আট সপ্তাহের ব্যবধানে এ টিকার দুটি ডোজ নিতে হবে সবাইকে।

সরকার সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে যে তিন কোটি ডোজ টিকা কিনছে, তার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ সোমবার দেশে পৌঁছেছে। এছাড়া সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। এরপর প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে বাকি আড়াই কোটি ডোজ দেশে আসার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশে যেহেতু এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি, তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী প্রথম দফায় ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির উপর এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে।

সব ঠিক থাকলে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন।

সরকার তিন ভাগে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সম্মুখসারিতে থাকা কর্মীদের অগ্রাধিকার দিয়ে এক কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ৯৭৩ জনকে প্রথম পর্যায়ে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে।

করোনাভাইরাসের টিকা পেতে আগ্রহী সবাইকেই নিবন্ধন করতে হবে। সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www.surokkha.gov.bd) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধনের কাজটি সারতে হবে।

‘ভয় পাচ্ছো না তো?’

টিকাদান কার্যক্রম শুরুর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের বেইজমেন্টে। বিকাল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠান শুরুর আগেই সেখানে আসেন টিকা নিতে আগ্রহী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৩২ জন প্রতিনিধি। তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ২৬ জনকে টিকা দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করার পর প্রথম টিকা দিতে ডাকা হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে।

রুনু নির্দিষ্ট বুথে বসার আগে দুই হাত জড়ো করে নমস্কার জানিয়ে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুভ অপরাহ্ন।”

রুনু চেয়ারে বসার পর দুজন স্বাস্থ্যসেবাকর্মী তাকে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী তখন রুনুকে জিজ্ঞেস করেন “তোমার ভয় লাগছে না তো?”

রুনু মাথা নেড়ে উত্তরে বলেন- “না”। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেন, “খুব সাহসী তুমি “

টিকা দেওয়া হয়ে গেলে সবাই করতালি দিয়ে রুনুকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রুনু তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তুমি সুস্থ থাকো, ভালো থাকো, আরো অনেক রোগীর সেবা কর, সেই দোয়া করি।”

এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন রুনু। হাত উঁচু করে কণ্ঠে তোলেন বাঙালির সেই উজ্জয়নী স্লোগান- “জয় বাংলা।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই এ সময় হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কণ্ঠ মেলান।

প্রথম পাঁচজনকে টিকা দেওয়ার সময় প্রত্যেকের সঙ্গেই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের অভয় দেন।

দেশে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া শুরু করার পর বুধবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সাংবাদিকদের সামনে আসেন উচ্ছ্বসিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

‘সবাই ভালো আছেন’

প্রথম পাঁচজনকে টিকা দেওয়া শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও কনফারেন্সও শেষ হয়। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যাদের প্রথম টিকা দেওয়া হয়েছে, তারা ভালো আছেন।

“আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তারা সবাই ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।”

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে একযোগে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরুর জন্য ৪২ হাজার কর্মী মাঠে কাজ করছেন।

“জেলা-উপজেলা পর্যায়ে টিকা দেওয়ার পর প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কারো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন চিকিৎসকেরা। এভাবে আগামী জুনের মধ্যে দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষকে করোনা টিকা দেওয়ার হবে।”

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কারো কারো মধ্যে ‘নেতিবাচক’ ধারণা রয়েছে। তা দূর করতেই পুলিশ, সাংবাদিক, ডাক্তার, নার্সসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রথম টিকা দেওয়া হয়েছে।

রসিকতা করে তিনি বলেন, “এখন যারা নেতিবাচক আলাপ আলোচনা করেন, তাদেরকে করোনা টিকা দেওয়া হবে। যাতে তারা সুস্থ থেকে সরকারের আরও বেশি সমালোচনা করতে পারেন।”

দেশে টিকাদান শুরুর দিনে বুধবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক নার্স। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা কবে টিকা নেবেন- এমন প্রশ্নে জাহিদ মালেক বলেন, “দেশের সবাই টিকা নেওয়ার পর নেব। না হয় মানুষ বলবে- আগে মন্ত্রীরাই করোনার টিকা নিয়ে গেছেন।”

তবে ৭ ফেব্রুয়ারি যখন সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গণ টিকাদান শুরু হবে, তখন সরকারের অনেকেই এই টিকা নেবেন বলে জানান মন্ত্রী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “বুধবার অল্প কিছু মানুষকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচির শুভারম্ভ হয়েছে। যারা টিকা দিতে চেয়েছেন, তাদের সবাই টিকা দিতে পেরেছেন। প্রথমদিন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যক্রম শেষ হয়েছে।”

যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের শারীরিক অবস্থা কেমন জানতে চাইলে ডা. ফ্লোরা বলেন, “তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সব সময় সঙ্গে সঙ্গে হয় না। টিকা নেওয়া প্রত্যেকেই বাড়ি চলে গেছেন।

“একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। যে কোনো টিকাতেই কিন্তু মৃদু টাইপের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে এতে মারাত্মক কিছু আছে কি না তা আমরা দেখছি। আমাদের টিম তৈরি করা আছে তাদের ফলোআপ করার জন্য।”

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলী নূর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান, বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।