টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কা কতটুকু?

নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটানোর পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে শুরু হচ্ছে গণ টিকাদান। তবে টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা নিয়ে শঙ্কাই বা কতটুকু- এসব প্রশ্ন আছে অনেকের মনে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2021, 06:42 PM
Updated : 15 Jan 2021, 06:42 PM

সব ধরনের টিকারই কিছু না কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি নভেল করোনাভাইরাসের যে টিকা দেওয়া হবে, সেটিও ব্যতিক্রম নয়।

তবে ‘কোভিশিল্ড’ নামের এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময় যতটুকু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা নিয়ে আতঙ্ক বা অস্বস্তির কারণ নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলেছে, পরীক্ষামূলক প্রয়োগে তাদের এই টিকা গড়ে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে।  

বাংলাদেশ কিনেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা। সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বে টিকার সবচেয়ে বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।

কোভিশিল্ড টিকার সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সেরাম ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ টিকা নেওয়ার পর হালকা গা ব্যথা, শরীর গরম, লালচে হয়ে যাওয়া, চুলকানি, টিকা দেওয়ার স্থান ফুলে যাওয়া, সেখানে ক্ষত হওয়া, অসুস্থ-ক্লান্ত বোধ করা, ঠাণ্ডা বা জ্বর জ্বর লাগা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, জ্বর, ফ্লুর উপসর্গ- ইত্যাদি দেখা দিতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে।

টিকা নিয়েছেন এমন ১০ জনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এসব সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

আবার মাথা ঘোরা, ক্ষুধামান্দ্য, পেট ব্যথা, অতিরিক্ত ঘাম, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠার মতো কিছু অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কখনও কখনও দেখা দিতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে প্রতি ১০০ জনে একজনের ক্ষেত্রে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা। ছবি: রয়টার্স

যাদের এলার্জির সমস্যা আছে, জ্বর হয়েছে, রক্তে কোনো সমস্যা আছে বা রক্ত পাতলা রাখতে ওষুধ নিচ্ছেন, যাদের রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা একেবারেই কম বা কোনো ওষুধ গ্রহণের কারণে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়েছে, যারা গর্ভবতী বা সন্তান নেওয়ার চিন্তা করছেন, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এবং করোনাভাইরাসের অন্য কোনো টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের টিকা নিতে নিরূৎসাহিত করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে অক্সফোর্ডের টিকার ‘মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’ নেই।

এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগটি বাংলাদেশে হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটা আছে সে বিষয়ে আরও শক্ত প্রমাণ থাকত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পরামর্শক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারতের আবহাওয়া, সংস্কৃতি এবং মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। এ কারণে সেখানে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ভালো ফলাফল বাংলাদেশের জন্য আশা জাগানিয়া।

“মন্দের ভালো সেখানে প্রয়োগ হয়েছে এবং যে ফলাফল, তাতে কোনো আশঙ্কার কারণ নেই। টিকাটি যথেষ্ট কার্যকর এবং নিরাপদ। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় বাংলাদেশে এই টিকা কার্যকর হবে। হয়তো দুই-একজনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটা খুব অস্বস্তির হওয়ার মতো না।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান খসরুর মতে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তার অসুবিধার চেয়ে মহামারীর সময়ে এই টিকা পাওয়ার সুবিধাই বেশি।

“এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকির মাত্রা গ্রহণযোগ্য। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। আমরা যদি অনেক মানুষকে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যাই তাহলে টিকা দিতে হবে।”

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা। ছবি: রয়টার্স

তবে টিকা দেওয়ার পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে- এমনটা ধরে নিয়ে তার জন্য প্রস্তুতি আগেই নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“ভ্যাকসিন আসা শুরু করেছে, এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটা আরও আগে নিতে পারত। তবে এখনও হাতে পনের-বিশ দিনের মত সময় আছে। চেষ্টা করলে এখনও প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।”

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা বিনবে বাংলাদেশ। এর প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে। সবকিছু ঠিক থাকলে টিকা প্রয়োগ শুরু হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।

ইতিমধ্যে সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশ এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শিগগিরই অনুমোদন দেবে বলে আশা করছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা সে বিষয়ে সবসময় অন্য দেশের দিকেও নজর রাখা হচ্ছে।

“সাধারণ যে প্রতিক্রিয়াগুলো হয় সেই খবর পাওয়া যাচ্ছে। যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে সেগুলো মোকাবেলা আমাদের চিকিৎসকরা করতে পারেন। আমাদের সক্ষমতা আছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এই টিকায় কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় সে বিষয়ে অধিদপ্তর সব ধরনের তথ্য নিয়েছে। টিকা দেওয়ার পর আরও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবে একটি কমিটি।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা। ছবি: রয়টার্স

“আমার মনে হয় খুবই কম মানুষের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকবে। যে কোনো ওষুধের ক্ষেত্রেই এ আশঙ্কা থাকে। যেহেতু নতুন ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, তাই আমরা প্রাথমিকভাবেই পরিকল্পনার করেছি। এ ধরনের রিঅ্যাকশন হলে যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয় তা থাকবে। মোবাইল টিম থাকবে, টিকাদান কেন্দ্রে বেসিক নিডস এবং ওষুধ থাকবে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসি অ্যান্ড এএইচ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, ভারত ১৬ জানুয়ারি থেকে টিকা প্রয়োগ শুরু করবে। পশ্চিমবঙ্গেও এই টিকার প্রয়োগ শুরু হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ভারতে টিকার প্রয়োগের ওপর নজর রাখছে।

“সেখানে টিকা দেওয়ার পর যে ফলাফল আসবে তা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা দেবে। ভারতে আগে দিক, সেটা আমাদের জন্য একটা বড় ট্রায়াল হয়ে যাবে।”