সারা দেশে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনও না হওয়ায় মৃত্যু বাড়ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে ৩৬ জনের মৃত্যু নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৮০ জনে। এর মধ্যে ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে ২২ থেকে ২৮ নভেম্বর, দেশে সংক্রমণ শুরুর ৩৮তম সপ্তাহে। এর আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২১ নভেম্বর মৃত্যু হয় ১৭৭ জনের। তার আগের ৩৬তম সপ্তাহে (৮ থেকে ১৪ নভেম্বর) মৃত্যু হয়েছিল ১২৪ জনের।
এই হিসাবে ৩৬তম সপ্তাহের তুলনায় ৩৮তম সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে ১০৬ জনের, ৮৫ শতাংশের বেশি। আর বিগত সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ৫৩ জনের, প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
এই তিন সপ্তাহে সরকারি হিসাবে দৈনিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যাও বেড়ে দুই হাজার আশপাশে উঠেছে। শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ১ হাজার ৯০৮ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার ৬১৯ জন হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যু নিশ্চিত করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর।
এরপর একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ২ জুলাই, ৪ হাজার ১৯ জন। আর একদিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ৩০ জুন, ৬৪ জন। এরপর কয়েক মাসে ধীরে ধীরে দৈনিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই কমতে থাকে। প্রকৃতিতে শীতের ভাব শুরু হওয়ার পর অক্টোবরের শেষ দিকে ফের বাড়তে থাকে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা। বিগত তিন সপ্তাহে বেড়েছে মৃত্যুও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ মানুষের সংখ্যাই বেশি।
হঠাৎ করে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংক্রমণের শুরুতে বয়স্করা একটু সাবধান ছিলেন। লকডাউন তুলে নেওয়ার পর তারা আগের মতো আর নিয়ম মানছেন না।
“লকডাউনের সময় বয়স্করা বলতে গেলে বাসার বাইরে বের হতেন না। মে মাসে লকডাউন তুলে দেওয়ার পর তারা এখন বাইরে আসছেন। এছাড়া পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন, তাদের মাধ্যমে বয়স্করা সংক্রমিত হচ্ছেন।”
ডা. বে-নজীর বলেন, শীতের সময় বয়স্কদের মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
“শীতকালে হাঁপানি, ব্রংকাইটিসসহ শ্বাসনালীর নানা ধরনের সমস্যা হয়। সঙ্গে যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয় তাহলে বয়স্কদের অক্সিজেনের লেভেল আরও কমে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইসিইউর যে চাপ রয়েছে তাতে সঠিক চিকিৎসা ব্যাহত হয়। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের মতে, সারা দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ না থাকায় করোনাভাইরাসে মৃত্যু বাড়ছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও অনেক জেলায় আইসিইউ সুবিধা নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই অনেক জায়গায়।
“জেলায় কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে আইসিইউ সুবিধা দেওয়া গেল না। সেই পেশেন্টকে নিয়ে আসলেন ঢাকায় বা বড় শহরে। নিয়ে আসতে রাস্তায়ই সে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। নিয়ে আসার পর কেউ হয়ত আইসিইউতে ভর্তি হল, কেউ ভর্তি হতেই পারল না। সাধারণ বেডে ভর্তি হল। এভাবেই মৃত্যুর হার বাড়ছে।”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা পর্যায়ে আইসিইউর ব্যবস্থা রাখার কথা বললেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানান ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এটা কিন্তু পেরিফেরিতে দেখা হচ্ছে না। প্রথম দিকেই আমরা বলেছিলাম উপজেলা পর্যন্ত সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে হবে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই না হলে আইসিইউ করা যায় না। ভেন্টিলেশন, হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা দেওয়া যায় না। এটা করতে পারলে অনেক রোগীর উপকার হত।”