টিকায় বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার: শ্রিংলা

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা ভারতে উৎপাদিত হলে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রতিবেশী দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2020, 12:20 PM
Updated : 19 August 2020, 02:04 PM

বুধবার এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের জন্য বাংলাদেশ সব সময় অগ্রাধিকারে আছে।”

দুপুরে হোটেল সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসা শ্রিংলা।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে টিকা আবিষ্কারে নেমেছে বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কৃত টিকা তৃতীয় ধাপের চূড়ান্ত পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।

কোনো টিকার চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিপুল সংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার ফলাফল দেখতে হয়। পরীক্ষায় নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই সেই টিকা অনুমোদন পায়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত টিকার পরীক্ষা ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটি অফ ইন্ডিয়া (এসআইই)। দ্বিতীয় ধাপ থেকেই এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে যাচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী এই সংস্থা।

ভারত বিশ্বের ৬০ ভাগ টিকা উৎপাদন করে জানিয়ে শ্রিংলা বলেন, “যখন টিকা আবিষ্কার হবে, আমাদের বন্ধু, সহযোগী এবং প্রতিবেশী দেশগুলো এর অংশীদার হবে।”

টিকার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, “আমরা টিকা আবিষ্কারের কাজ করছি, যা এখন পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে উচ্চতর (অ্যাডভান্সড লেভেল) পর্যায়ে রয়েছি। 

“আমরা টিকা উৎপাদন করতে যাচ্ছি এবং আমরা বড় পরিসরে তা উৎপাদন করব।”

এদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

তিনি বলেন, “কোভিড নিয়ন্ত্রণে ভারতের যে প্রচেষ্টা চলছে, আমরা জানি যে কিছু ভ্যাকসিন সেখানে ডেভেলপ করছে এবং ট্রায়ালও শুরু হয়ে গেছে।

“আমরা অফার করেছি যদি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, ট্রায়ালের ক্ষেত্রে, তাহলে আমরা প্রস্তুত আছি।”

ভারত এক্ষেত্রে সাড়া দিয়েছে জানিয়ে মাসুদ বলেন, “তারাও প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বলেছে, যে ভ্যাকসিনগুলো ডেভেলপ করছে, সেগুলো শুধু ভারতের জন্যই নয়, প্রথম দিকেই আমাদের জন্য সেটা ‘অ্যাভেইলেবল’ করা হবে।

“এবং আমাদের যে ওষুধ কোম্পানিগুলো আছে, তাদেরও সক্ষমতা আছে। ‍সুতরাং তারা ওগুলোতে কোলাবোরেশনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছি।”

‘হঠাৎ ও খুব সংক্ষিপ্ত’ সফরে আসার গুরুত্ব তুলে ধরে শ্রিংলা বলেন, “মঙ্গলবার আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন কারও সঙ্গে দেখা করছেন না।

“আমি এসেছি, কারণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। কারণ এই কোভিড পরিস্থিতির কারণে মুখোমুখি সাক্ষাৎ নেই, তবে সম্পর্কটা জারি রাখতে হয়। আমাদের দ্বিপক্ষীয় শক্তিশালী সম্পর্ক চালু রাখা উচিত। প্রাথমিকভাবে আমি ঢাকায় এসেছি।”

আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভারত কী করছে, তা আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছি।

“কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদেরও রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা, এ কারণে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মূলত আমাদের মৃত্যু হার কম এবং সুস্থতার হার বেশি।”

গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ বার্তা নিয়ে আকস্মিক সফরে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা।

কী ‘বিশেষ বার্তা’ তিনি এনেছেন, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বলেন, “বিশেষ বার্তা হচ্ছে, কোভিডের কারণে যেহেতু বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক নাই কোনো দেশেরই। সেটার একটা ব্রেকথ্রু হিসাবে আমরা দেখছি এই সফরটাকে। তিনি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এখানে এসেছেন এবং এটা উনারও প্রথম সফর এই কোভিডের সময়ে।”

তিনি আরও বলেন, “উনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দিল্লিতে যাওয়ার জন্য। জয়েন্ট কনসাল্টিং কমিটির মিটিং হবে, তার আগেই হয়ত আমি একবার যাব। দুই দেশের মধ্যে এই ধরনের মিটিং নরমাল সময়ে অনেক হইত, কোভিডের কারণে হয়ত সম্ভব হয়নি।”

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে কাজ করার আশ্বাস দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশেরই প্রতিবেশী ভারত।

“আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের ‍সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের অবস্থান নেওয়া দরকার। আমরা এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে কাজ অব্যাহত রাখব।”

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আপনারা জানেন ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে, আমরা এটাতে সমর্থন দিয়েছি। জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে তারা নিরাপত্তা পরিষদে বসবে। নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়।

“আমাদের একটা কনসার্ন আছে, রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা অতীতে অনেক চেষ্টা করে এসেছি, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে রেজুলেশন পাস করা যায়, আপনারা জানেন, কিছু কিছু পার্মানেন্ট রাষ্ট্রের ভিটো ক্ষমতার কারণে আমরা এটা করতে পারিনি। এক্ষেত্রে আমরা ভারতের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছি।”

দ্বিপাক্ষিকভাবে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা অবকাঠামোসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে দিচ্ছে রাখাইন রাজ্যে। এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরে তারা সেখানে থাকবে।

“সে ব্যাপারেও যেন বৃহত্তর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখে এবং মিয়ানমারকে পারসুয়েড করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে। নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পথ তৈরি করে আমরা সে ব্যাপারেও তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কারণ তারা দুই দেশ সম্পর্কে এবং এর অগ্রগতি সম্পর্কে বেশি জানে।”

আরও যা ছিল আলোচনার টেবিলে

প্রায় দেড় ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বৈঠকের নানা দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

তিনি বলেন, “আমরা মূলত কোভিড পরিস্থিতিতে এবং কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। দুই দেশের সম্পর্ককে কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এ ব্যাপারে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি।

“আর এই কোভিডের সময়ে যে ভালো কাজগুলো হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বেনাপোল স্থল বন্দরে মালামাল পরিবহন বন্ধ থাকার পর রেলে তা চালু এবং ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রসঙ্গও বৈঠকের আলোচনায় ছিল বলে জানান তিনি।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় কিছু কাজ কোভিডের কারণে থেমে গিয়েছিল। ভারত থেকে কনসালটেন্ট যারা ছিলেন, তারা কোভিডের কারণে চলে গিয়েছিলেন, সেগুলো আবার কিছু কিছু আসা শুরু করেছে।”

দুই দেশের মধ্যে ‘এয়ার বাবল’ তৈরির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছে সেক্ষেত্রেও আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারা প্রস্তাব দিয়েছে আমাদের প্রতিনিধির কাছে, এটা আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করব এবং খুব দ্রুতই তৈরি করতে পারব।

“সেক্ষেত্রে যে সকল বাংলাদেশি ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়, তারা যেতে পারবে। একইসঙ্গে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে ভারতের যে কনসালটেন্টরা আছে, তারাও ‍সুবিধা নিতে পারবে।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভারতের যে কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলো যাতে ত্বরান্বিত করা যায়- সে পথ বের করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।

সীমান্তে হত্যা সম্পর্কে শ্রিংলার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগামী মাসে বিজিবি ও বিএসএফের ডিজি লেভেলের মিটিং। সে মিটিংয়ের আগে উনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিবেন। যাতে করে অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যু আমরা কমিয়ে আনতে পারি।

”এই বছরের প্রথম ছয় মাস সাত মাসে এটা বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ তাদেরকে বলেছি।”

তাবলীগ জামাতের মুসল্লীসহ ভারতের দুয়েকটা জায়গায় যেসব বাংলাদেশি আটকে আছেন, তাদের ফিরে আসার সুযোগ তৈরির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ।

বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর সম্পর্কে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “দুই দেশের বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল বা অন্যান্য মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়াতে যে সমস্ত খবর আমরা ইদানিংকালে দেখতে পেয়েছি, সে ব্যাপারে আমরা পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।

”এবং আমরা একমত হয়েছি যে, আমাদের মেইনস্ট্রিম যে সংবাদমাধ্যমগুলো আছে, সেখানে আমাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা, সম্পর্কের উন্নততর অবস্থার মধ্যেই আমরা আছি, সেটাকে আমরা আপনাদের (গণমাধ্যমের) সঙ্গে আরও আলোচনার মাধ্যমে এই মেসেজটা যেন আমরা দিতে পারি, কোভিডের সময় আমরা ফেইস টু ফেইস দিতে পারি নাই।”