গতিপথ বদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা বলবে এবার ‘অগ্রগতির’ কথাও

মহামারীর দুঃসময় পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, মানুষের জীবন অনেকটাই ফিরছে চেনা ছন্দে, বাংলা বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রাও আসছে ফিরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2022, 07:06 PM
Updated : 13 April 2022, 05:08 AM

তবে রাজধানীর যে পথ ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছিল তিন যুগ ধরে, এবার সেই পথ যাচ্ছে বদলে।

মেট্রোরেলের কাজের জন্য গতিপথ বদলে যাওয়া এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা দেশের অগ্রযাত্রার প্রতিধ্বনি তুলবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে রজনীকান্ত সেনের গান থেকে- ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাড়না থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার আয়োজনে পহেলা বৈশাখে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা নগরে বর্ষবরণের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে অনেকদিন ধরে। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও দেখা হয় এই কর্মসূচিকে।

গত শতকের ৮০ এর দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল, তাই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এই কর্মসূচি।

করোনাভাইরাস মহামারী হানা দেওয়ার পর ২০২০ সালে বর্ষবরণের অনেক আয়োজন গুটিয়ে যাওয়ার মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রাও হয়নি।

পরের বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও তা ছিল প্রতীকী, সেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগও ছিল না।

শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামোয়ও থাকছে সুসময়ের বিশেষ বার্তা।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে আসায় সংক্রমণ এড়ানোর বিধি-নিষেধের বেড়াজাল বিলুপ্ত হওয়ায় স্বাভাবিক মঙ্গল শোভাযাত্রার পথও খুলেছে।

ফলে আগামী বৃহস্পতিবার ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাতে আগের মতো সকাল ৯টায়ই শুরু হবে শোভাযাত্রা।

শুরু হবে টিএসসি থেকে, তবে এবার শাহবাগের দিকে না এগিয়ে যাবে নীলক্ষেতের দিকে।

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের কাজ চলায় শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বলে শোভাযাত্রার গতিপথে এই পরিবর্তন বলে জানান অধ্যাপক নিসার।

নতুন পথে শোভাযাত্রা টিএসসি থেকে শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনের চত্বর হয়ে টিএসসিতে ফিরে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “কোভিড-১৯ বিবেচনায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় জনসমাগম সীমিত রাখতে সকলের প্রতি অনুরোধ করা হচ্ছে।”

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক নিসার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশের অগ্রযাত্রার কথাও মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হবে।

শোভাযাত্রার মূল সুর নিয়ে তিনি বলেন, “এবারের প্রতিপাদ্য অনেকটা প্রার্থনা সঙ্গীতের মতো। অতিমারীর কারণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দটি হারিয়ে গিয়েছিল। পুনরায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে জীবন। সেই স্বাভাবিকতা ধরে রাখার প্রত্যাশায় এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য হয়েছে ‘নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’।”

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান 'নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে'

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বেশি জনসমাগম নিরুৎসাহিত করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক নিসার বলেন, স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি তারা বিবেচনায় রাখছেন। তবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা তারা নির্ধারণ করে দিতে চান না।

পহেলা বৈশাখের দুদিন আগে মঙ্গলবার চারুকলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, বরাবরের মতো উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন নিয়ে।

রঙের মুখোশ, সরা ও চিত্রকর্ম প্রদর্শন এবং বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। চারুকলার প্রাচীর রাঙিয়েছে আলপনায়। বিশালাকৃতির শিল্পকাঠামোর চূড়ান্ত রূপ দিতে চলছে শেষ মুহূর্তের তোড়জোড়।

ফুল আর পাখির মোটিফ

মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের শিল্পকাঠামোয়ও থাকছে প্রতিপাদ্য অনুসরণ করে সুসময়ের বিশেষ বার্তা।

আয়োজকরা বলছেন, এবারের শোভাযাত্রায় টেপা পুতুল, মাছ, পাখি ও ঘোড়া চারটি বিশালাকৃতির শিল্পকাঠামো বা মোটিফ দেখা যাবে। সঙ্গে থাকবে পুষ্পাকৃতির বিশাল চরকি। অংশগ্রহণকারীদের হাতে হাতে শোভা পাবে রাজা-রানী, বাঘ, পেঁচার মুখোশসহ লোকজ নানা অনুষঙ্গ ।

চারুকলার ২৬তম ব্যাচের অঙ্কন ও চিত্রাংকন বিভাগের শিক্ষার্থী সীমান্ত ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মোটিফ ব্যাখ্যায় বলেন, “ফুল ও পাখির সমন্বয়ে একটি বড় ফোক মোটিফ থাকবে। এই প্রতীকটা অনেক আগে গ্রাম্য মেলাগুলোতে বিক্রি করা হত। এখন সচারাচর দেখা যায় না। এবার ব্যতিক্রম হিসেবে এই স্ট্রাকচারটা তৈরি করা হচ্ছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা কর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি চারুকলার নবীন ও প্রবীন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলাও

“পাখি ও ফুল নিয়ে যে স্ট্রাকচারটা, যেখানে তিনটি সার্কেলে তিনটি পাখি, মাঝখানে থাকবে ফুল। উপরের বড় পাখিটা আমাদের একধরনের মুক্তির প্রতীক। বিশালাকারের পাখিটি অতীতের গ্লানি মুছে দিয়ে বলবে অনাগত সুদিনের কথা। ফুল সেখানে নান্দনিকতা ছড়াবে।”

শোভাযাত্রার দায়িত্ব এবার চারুকলার ২২ ও ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। গত দুবছর বর্ণাঢ্য আয়োজন না হওয়ায় এবার দুটি ব্যাচ একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।

২২তম ব্যাচের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আনিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যারা ২২তম ব্যাচের, তারা ২০২০ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের কথা ছিল। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তো সেটা করা গেল না, তাই এবার ২২ ও ২৩ ব্যাচ মিলে কাজ করছি।”

তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা কর্মযজ্ঞ নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একে ঘিরে চারুকলার নবীন ও প্রবীণ শিক্ষার্থীদের মিলনমেলাও ঘটে।

চারুকলার জয়নুল আবেদিন গ্যালারিতে হরেক রকমের শিল্পকর্মের পসরা নিয়ে বসেছেন শিক্ষার্থীরা। কিছু বিক্রির জন্য, যা দিয়ে শোভাযাত্রার খরচ মেটানো হয়, আর কিছু  বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।

২৭তম ব্যাচের অঙ্কন ও চিত্রাংকন বিভাগের  শিক্ষার্থী  সুবর্ণ চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমার শিল্প কর্মের মাধ্যমে আমাদের  মাটি ও মানুষের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমাদের একেক এলাকায় একক রকমের ট্যাপা পুতুল থাকে, সেগুলো আমরা তৈরি করার চেষ্টা করি।”

আনিকা বলেন, “ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার পালনীয় উৎসব। এ উৎসবের জন্য কাজ করতে আমাদের খু্বই ভালো লাগে।বিশেষ করে  ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করায় এটি আমাদের গর্বের।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে উঠেছে নগরে বর্ষবরণের অনুসঙ্গ।

বিধিনিষেধ

স্বাস্থ্যবিধি পালনের আহ্বানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবারও কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে।

সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলার তৈরি মুখোশ হাতে রাখা যাবে। ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা না বাজানো ও বিক্রি না করতে বলা হয়েছে।

নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসের সব ধরনের অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। বিকাল ৫টার পর আর ক্যাম্পাসে ঢোকা যাবে না, কেবল ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা বের হতে পারবে।

সেদিন ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের যানবাহন চালানো যাবে না এবং মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষেধ থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাসরত কোনো ব্যক্তি নিজস্ব গাড়ি নিয়ে যাতায়াতের জন্য শুধু নীলক্ষেত মোড় সংলগ্ন গেইট ও পলাশী মোড় সংলগ্ন গেইট ব্যবহার করতে পারবেন।

নববর্ষের দিন টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক বন্ধ থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার জন্য চারুকলা অনুষদের সামনের ছবির হাটের ফটক, বাংলা একাডেমির সামনের উদ্যানের ফটক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট সংলগ্ন ফটক ব্যবহার করা যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল মাঠ সংলগ্ন এলাকা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকা, দোয়েল চত্বরের আশে-পাশের এলাকা ও কার্জন হল এলাকায় মোবাইল পাবলিক টয়লেট রাখা হবে।