বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ওসমান জামাল মিলনায়তনে সপ্তাহব্যাপী ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বিশেষ ভাস্কর্য প্রদর্শনীর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী বলেন, “তারা ভাস্কর্য নিয়ে এদেশে মিথ্যাচার করেছে, ভাস্কর্যকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ওদের ‘খোঁচায়’ দেশে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ও প্রচার অনেক বেশি হচ্ছে।
“যেসমস্ত ধর্ম ব্যবসায়ীরা মনে করে ভাস্কর্য আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বা ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায় না, ওই মুর্খরা জানে না মুসলমান মেজরিটি দেশেও কিন্তু ভাস্কর্য রয়েছে।
২০২০ সালের শেষ দিকে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের বিরোধিতায় সরব হয়। ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়ার’ হুমকিও দেওয়া হয়।
এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যেই গভীর রাতে কুষ্টিয়া শহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়।
আ ক ম মোজাম্মেল বলেন, “এরা সেই পাপিষ্ঠ, যারা একাত্তরের আমাদের মা বোনদের বলেছিল গনিমতের মাল। ধর্ষণ করা জায়েজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মা বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতনকে এরা সমর্থন করেছিল।
“এরা আজকে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে। তবে যেমন কুকুর, তেমন মুগুর দিতে পারলে ঠিক হবে।”
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৮ থেকে ২৪ মার্চ দুটি গ্যালারিসহ চারুকলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী বিশেষ ভাস্কর্য প্রদর্শনী।
“কোভিডের কারণে সময় মতো করা যায়নি। তবে এটা বছরব্যাপী চলবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভাস্কর্য শিল্পের মাধ্যমে শাণিত করতে বিভাগীয় পর্যায়ে বছরব্যাপী এধরনের ভাস্কর্য প্রদর্শনী হবে।”
গাজীপুরে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে দেশের প্রথম ভাস্কর্যটি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে উল্লেখ করে চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারপার্সন নাসিমা হক মিতু মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এ প্রসঙ্গে আ ক ম মোজাম্মেল বলেন, “আমি খুবই গৌরবান্বিত যে, বাংলাদেশের প্রথম নির্মিত ভাস্কর্য গাজীপুরে, আমার নির্বাচনী এলাকায়। এটার সঙ্গে আমার আবেগ জড়িত। আপনারা বলেছেন এটার ভবিষ্যত কী?
“সেখানে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে, ফ্লাইওভার হবে। এটা এমন জায়গায় পড়েছে, ওভাবে থাকবে কি না? আমি বলতে চাই, এটা থাকবে, এটা বাংলাদেশের প্রথম ভাস্কর্য।”
তিনি বলেন, “আমরা কিছুদিন পরেই ভাস্কর্যের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে নিয়ে একটা কমিটি করে এই ভাস্কর্যটি কোন জায়গায় কীভাবে প্রতিস্থাপিত হলে এটা আরও বেশি আকর্ষণীয় ও সুন্দর হবে, সরেজমিনে দেখে সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “এই ভাস্কর্য প্রদর্শনী উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমুচিত জবাব দেওয়ার শক্তিশালী উপায়।”
সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব উল্লেখ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সকল ভাস্কর্যের অনুলিপি তৈরি করে একটি জাদুঘরে রাখার পরামর্শ দেন ঢাবি উপাচার্য।
“দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো, বিশেষ করে যে ভাস্কর্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটি করে রেপ্লিকা তৈরি করে একটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকার সহযোগিতা করলে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নেবে।”
প্রদর্শনীতে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের বাছাই করা ২৬টি ভাস্কর্য স্থান পায়। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান এবং শহরে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মারক ভাস্কর্যের আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রদর্শনীতে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের ছয়টি ভাস্কর্য এবং কিছু ভাস্কর্যের আলোকচিত্রও রাখা হয়। এছাড়া আলোকচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মারক ভাস্কর্যের প্রামাণ্যকরণ করা মোজ্জামেল হক টিটুর আলোকচিত্র থেকে বাছাই করা ৫০টি ভাস্কর্যের আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়।
এছাড়া প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া তিনটি শিল্পকর্মকে পুরস্কৃত করা হয়। ‘জাতির জনক’ শীর্ষক আবক্ষ ভাস্কর্যের জন্য ইসমে আজম, পল্লব দত্ত ও শেখ সাহাবুদ্দিনকে যৌথভাবে প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয়।
‘রক্তবর্ণ’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্থাপনা শিল্পের জন্য অমিয় শংকর দাসকে দ্বিতীয় পুরস্কার এবং ‘অভ্যন্তরীণ অর্জন’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যের জন্য রূপম রায়কে তৃতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট, সনদ ও পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রদর্শনীর আহ্বায়ক ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বক্তব্য দেন।