‘ডাউন সিনড্রোম' বৈশিষ্ট্যের শিশুদের পিছিয়ে রাখা যাবে না’

সমাজের মূলধারা থেকে আলাদা করে নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে সব কাজে আর দশজনের মতো 'ডাউন সিনড্রোম' বৈশিষ্ট্যের শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদ নিয়ে নানা কর্মসূচিতে পালিত হল 'বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস'।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2022, 06:09 PM
Updated : 21 March 2022, 06:09 PM

'একীভূত সমাজব্যবস্থা, অংশগ্রহণে বাড়ায় আস্থা’ প্রতিপাদ্যে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি অব বাংলাদেশ, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল ও আমডা বাংলাদেশ যৌথভাবে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে।

জন্মগত জেনেটিক ত্রুটির কারণে কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন মাংসপেশির শিথিলতা, কম উচ্চতা, চোখের কোণা উপরের দিকে ওঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোটো কান, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা, জিব বের হয়ে থাকা ইত্যাদি। এগুলো ডাউন সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য।

২০১২ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে 'বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস' এর স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ২১ মার্চ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস' পালিত হল এ নিয়ে চতুর্থবারের মত।

দিনের কর্মসূচির মধ্যে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও 'ডাউন সিনড্রোম' বৈশিষ্ট্যের শিশু, কিশোর ও ব্যক্তিদের নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয়।

শোভাযাত্রা পর শিশুরা দলীয় নৃত্য পরিবেশনা করে এবং এর পর শুরু হয় আলোচনা সভা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান অনুষ্ঠানে বলেন, 'ডাউন সিনড্রোম' বৈশিষ্ট্যের শিশুরা অন্য সব শিশুর মতই।

“জিনগত কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে তাদের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, যা তাদের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে তাদের মধ্যে কিছু গুণ আছে, যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তাদের সরলতা, আন্তরিকতা ও সততার শিক্ষা আমাদের মধ্যে থাকা জরুরি। ওদের এই গুণাবলী আমরা ধারণ করতে পারলে একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।“

ডাউন সিনড্রোম বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং গবেষণায় জোর দেন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডাউন সিনড্রোম বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন ন দিগন্তের সূচনা করতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

উপাচার্য বলেন, “টেকসই উন্নয়নের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। সেই সমাজ গঠনে এই শিশুদের পশ্চাতে রাখা যাবে না। এ শিশুদের কোনোই দোষ নেই। তারা অন্য পাঁচটি শিশুর মতই।”

বাংলাদেশের ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির সভাপতি সরদার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ডাউন সিনড্রোম শিশু এবং সেল্ফ অ্যাডভোকেটরা আমাদের মতই। আমাদের মত তাদের ব্যাক্তিগত অনুভূতি এবং চাহিদা আছে।

“তাদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, আবার কেউ গাড়ি কেনার ইচ্ছাসহ অন্যান্য অনুভূতি প্রকাশ করে। আমরা যদি তাদের চাহিদা এবং অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন হই, তাহলে তারা তুলনামূলকভাবে সহজ জীবন যাপন করতে পারবে।”

এই শিশুদের জন্য উদ্ভাবন ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি জনিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “তারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পছন্দ করে না এবং তারা এই শিক্ষা কারিকুলামের সাথে মানিয়েও নিতে পারে না। তাদের জীবনকে আরও মসৃণ এবং সহজ করতে ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন।

সভাপতির বক্তব্যে যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারপার্সন তাওহিদা জাহান বলেন, “দিবসটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ডাউন সিনড্রোম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মিলনমেলায় ‘একীভূত সমাজ ব্যবস্থা, অংশগ্রহণ বাড়ায় আস্থা' স্লোগাটিন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।”

'ডাউন সিনড্রোম' বৈশিষ্ট্যের জনগোষ্ঠী সমাজের মূলধারায় একীভূত হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অংশ নেবে বলেও প্রত্যাশা রাখেন তিনি।

কেন 'ডাউন সিনড্রোম' দেখা দেয়?

বেশি বয়সে মা হলে, বিশেষ করে ৩৫ বছর বয়সের পরে সন্তান নিলে সেই সন্তানের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যেতে পারে। কোনো মায়ের আগে এমন বৈশিষ্ট্যের শিশু থাকলে পরের শিশুর ক্ষেত্রেও একই বৈশিষ্ট্য দেখা যেতে পারে।

পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এই শিশুরা অন্যদের চেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে দেরিতে বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠার মাইলফলকগুলো- যেমন বসতে শেখা, দাঁড়াতে শেখা, হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা এসব দেরিতে হয়র। জন্মগত তারা হার্টের সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সমস্যা, ঘন ঘন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ- ইত্যাদি জটিলতায় ভুগতে পারে।

ডাউন সিনড্রোমের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, জটিলতা দেখা দিলে তার চিকিৎসা করতে হয়। তবে আগে থেকে রোগ শনাক্ত করা গেলে জটিলতা কম হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক জিয়া রহমান, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম রাব্বানী, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. হাকিম, আরটিভির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর সৈয়দা মুনিরা ইসলাম, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী অধ্যাপক সোনিয়া ইসলাম নিশা এবং সহকারী অধ্যাপক শারমিন আহমেদসহ বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে আরও ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং ইনফোগ্রাফিক বই ‘একুশে এক্সট্রা’র অনলাইন সংস্করণের প্রকাশনা অনুষ্ঠান।