গেল কয়েকদিন ধরে টিএসসির সব চা দোকানের টং, টেবিল কিংবা চারপাশের আঙিনাকে রাঙানো হয়েছে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায়।
‘দ্বিতীয় অধ্যায়: চায়ের কাপে রিকশাচিত্র' শিরোনামে এ উদ্যোগ নিয়েছেন ২০১৯ সালের মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার বিজয়ী শিরিনা আক্তার শিলা এবং তার বন্ধুরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী বলেন, প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকেই তারা এটা শুরুর পরিকল্পনা করছেন।
“মানুষ বলে, টিএসসি ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র; স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি অতীতের সব আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ এখান থেকেই এসেছে। তাই আমরা যদি টিএসসির রঙ পরিবর্তন করতে পারি, তবে আমরা আমাদের সমাজের রঙও পরিবর্তন করতে পারব।"
রিকশাচিত্রকে বাঙালির ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে বর্ণনা করে শিলা বলেন, “রিকশা পেইন্ট আমার প্রিয় ঢাকা শহরেই গত শতকে গড়ে ওঠা এক নান্দনিক শিল্পমাধ্যম। বর্ণিল ও স্বতন্ত্র এই অপূর্ব অংকন শৈলী ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে সমাদর লাভ করেছে।
শিলা বলেন, “আমার প্রিয় শহর ঢাকার একান্ত নিজস্ব এই চিত্রশৈলী সংরক্ষণ এবং ঢাকা শহরের সড়ক আরও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ‘দ্বিতীয় অধ্যায়: চায়ের কাপে রিকশাচিত্র' আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
“ফোক আর্টকে আমরা ব্যাক আনতে চাই। পুরানো সেই রিকশাচিত্রকে আমরা প্রথম অধ্যায় হিসেবে দেখছি। ডিজিটাল যুগে সেটাকে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে পুনর্জীবন দিতে চাচ্ছি। কেননা এটা আমাদেরই সংস্কৃতির অংশ।”
চায়ের স্টলে কেন এই উদ্যোগ? শিলা বললেন, চা স্টল হল মিলন ও শুভেচ্ছা জানানোর একটি সংযোগস্থল।
“যেখানে আপনি প্রতিটি প্রজন্মের মানুষ খুঁজে পাবেন- এটা তাদের দ্বিতীয় বাড়ির মত। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, রিকশাচালক, তাদেরও পাওয়া যাবে চায়ের স্টলে। অনেক সামাজিক উদ্যোগ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, বিপ্লবের স্ফূলিঙ্গ শুরু হয় টি-স্টল থেকে।
রিকশাচিত্র কী ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে ঢাকার সূত্রাপুর ও ওয়ারী এলাকায় বাহন হিসেবে রিকশার ব্যবহার শুরু হয়। তবে তখন ছিল মানুষে টানা রিকশার যুগ। ১৯৪৭এর দেশভাগের পর ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে সাইকেল রিকশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের শুরু। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাতে আঁকা এসব ‘আর্ট’ এর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল তিন চাকার এই বাহনকে নানা রঙে সাজিয়ে যাত্রীদের আকৃষ্ট করা। তা পূরণ করতে রিকশার গায়ে সবচেয়ে বেশি আঁকা হয়েছে চলচ্চিত্র আর নায়ক নায়িকাদের ছবি। মুক্তিযুদ্ধ, আরব্য রজনীর গল্প, কাল্পনিক নগর, ফুল-পাখির নকশাও বাড়িয়েছে রিকশার শোভা। ধীরে ধীরে এই রিকশাচিত্র হয়ে ওঠে শিল্পকর্মের আলাদা এক ধরন। ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে প্রায় ছয়শ রিকশা ও বেবিট্যাক্সি পেইন্টারের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছিল। এখন ডিজিটাইল সাইন আর করপোরেট বিজ্ঞাপনের যুগে রিকশা পেইন্টারদের হাতে কাজ নেই। তবে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের কেউ কেউ রিকশাচিত্রকে অন্য ক্যানভাসে তুলে এনে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় এগিয়ে এসেছেন। |
টিএসিসির আঙিনায় রিকশাচিত্র দেখে মুগ্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আতিকুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বললেন, “রঙ-তুলির আঁচড়ে আমাদের টিএসসির চায়ের দোকানগুলে এখন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। এটা দারুণ উদ্যোগ। আমরা যারা নিয়মিত টিএসসিতে আসি, তারা এখন চায়ের কাপে নতুন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। যেন পুরো টিএসসিই বদলে গেছে।”
প্রিয় আড্ডাস্থলে নান্দনিক আবহ পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন শিক্ষার্থী নিলয় কুমার। তার ভাষ্য, “নিঃসন্দেহে এটি অসাধারণ উদ্যোগ। এখানে সকল শ্রেণির মানুষ এসে আড্ডা দেয়। এখানে এমন একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সুন্দর সৃষ্টিকর্ম মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, চিন্তার বিকাশ ঘটায় এবং একজন রুচিশীল মানুষ হতে ভূমিকা রাখে।”
স্বপন মামা নামে পরিচিত টিএসসির চা দোকানি আব্দুল জলিলের কথায়, “আসলে আমরা খোলামেলা জায়গা চা বিক্রি করি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আড্ডা দেয়। চায়ের আড্ডায় তারা এই চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনা করছেন। উপভোগ করছেন সুন্দর এই চিত্রকর্ম।”
“বিশ্বায়নের যুগে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে টিকে থাকা যখন চ্যালেঞ্জ, সেসময় আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি- আমরা আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সমন্বয় করতে পারি, বাঙালি ও বিশ্ব নাগরিকের মধ্যে সমন্বয় করতে পারি।”