শিল্পের পসরা সাজিয়ে চারুকলায় ‘জয়নুল উৎসব’

টেপা পুতুল, নকশিকাঁথা, শীতলপাটিসহ লোকায়ত ঐতিহ্যের নানা শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘জয়নুল উৎসব’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2021, 01:00 PM
Updated : 29 Dec 2021, 01:33 PM

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষদের বকুলতলায় উৎসবের উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক  মো. আখতারুজ্জামান। এর আগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সবাই।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনের মেলারও আয়োজন করা হয়েছে চারুকলায়। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে বুধবার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত মৃৎপাত্র প্রদর্শন করা হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা মেলায় নিজেদের তৈরি নানা চিত্রকর্ম, নকশা, ঐতিহাসিক চরিত্রের ডিজিটাল ফটো, চারুকলা বিষয়ক গ্রন্থ ও কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য স্টল সাজিয়ে বসেছেন।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিল্পীরা সতরঞ্জি, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, শখের হাঁড়ি, মাটি ও কাঠের পুতুল, কোমর তাঁতের কাপড়, বাঁশি, পাখা, শোলা, শঙ্খ ও পটশিল্পসহ নানা পণ্যে স্টল সাজিয়েছেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের বার্তা শাখায় কর্মরত ইমরান উজ জামানের সংগ্রহে থাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৃৎপাত্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে জয়নুল গ্যালারিতে।

চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে জয়নুল মেলায় বুধবার সোনারগাঁও থেকে আসা বীরেন্দ্র সূত্রধরের কাঠের পুতুলের স্টল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমণ শিব কুমার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুস শাকুর শাহকে অনুষ্ঠানে জয়নুল সম্মাননা দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছর অনুষ্ঠান করতে না পারায় এবার জয়নুল উৎসবে ২০২০ সালের জন্য জাপানের শিল্পী শিরোকি তুসিউকি এবং বাংলাদেশের আবুল বারক আলভীকে পুরস্কার দেওয়া হয়।

চিত্রশিল্পী আলভী বলেন, “বাঙালি সংস্কৃতিকে বুঝতে এবং ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এমন উৎসব তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখাবে। বাঙালি তার ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতিকে ধারণ করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়বে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুল তলায় বুধবার সকালে চারুকলার শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তিন দিনের জয়নুল উৎসব। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

চারুকলা শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পুরোধা জয়নুল আবেদিন। পরে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ হিসেবে উন্নীত হয়।

ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ববাংলায় শিল্প শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু চেষ্টার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে শিল্পাচার্য অভিধা দেওয়া হয়। উদ্বোনী অনুষ্ঠানে সে অবদানের কথা তুলে ধরেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ।

তিনি বলেন, “তার অনবদ্য সৃষ্টি এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে চারুকলা শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। অনাগত ভবিষ্যতের প্রজন্মকেও নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিতে থাকবে এই প্রতিষ্ঠান।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭তম জন্মজয়ন্তীতে তার কবরে বুধবার শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“অসাধারণ শিল্পকর্মের মাধ্যমে তিনি মহান ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতিকে উজ্জীবিত করেন। শিল্পাচার্যের এসব কর্মপ্রয়াস শিল্পজগতে তাকে অমরত্ব এনে দিয়েছে।”

১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়ায় জয়নুল আবেদিনের জন্ম। ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বেড়ে উঠা জয়নুল তার ভেতরের শিল্পী সত্ত্বা দিয়ে বার বার পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছেন।

বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃৎ বরেণ্য এ শিল্পীর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে- দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা, নবান্ন, ফসল মাড়াই, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি।

উপাচার্য বলেন, “জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী ও মানবিক চিত্র এঁকে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছেন, যা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। তার অনন্য অবদানে বাংলাদেশের শিল্পচর্চা আজ ঈর্ষণীয় মানে পৌঁছেছে।”

জয়নুল উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ জয়নুল মেলা। মেলার স্টলগুলোতে পাওয়া যাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চারু ও কারু শিল্পীদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, “শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এই দেশ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি চারুকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।

“বাংলাদশে এই মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে আমাদের শিল্পকলা। বাংলাদেশে সেই শিল্পকর্মের যিনি পথিকৃত, সেই জয়নুল আবেদিনের ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।”

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত জয়নুল উৎসবে বুধবার চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে তিন দিনের লোকশিল্প মেলা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক আহমেদ উল্লাহ এবং শিল্পাচার্য-পুত্র খায়রুল আবেদিন উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন