সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য খুললো ঢাবির হলের দ্বার

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর সকল বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2021, 04:57 AM
Updated : 10 Oct 2021, 05:02 AM

রোববার সকাল ৮ থেকে দ্বিতীয় ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের অন্তত এক ডোজ টিকা নেওয়ার কার্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র দেখানো শর্তে হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।

এর আগে ৫ অক্টোবর থেকে প্রথম ধাপে স্নাতক চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হলে ওঠানো শুরু হয়।

দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের ফিরে পেয়ে হল প্রাধ্যক্ষরা তাদের রজনীগন্ধা ফুল ও চকলেট দিয়ে বরণ করে নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবদুল বাছির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম ধাপের মতোই দ্বিতীয় ধাপের জন্য আমরা সব ব্যবস্থা নিয়েছি। হলের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। ভেতরে ঢোকার আগে সবার তাপমাত্রা মেপে দেখা হচ্ছে।"

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে গত বছরের ১৮ মার্চ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়; খালি করে দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও। এখন আবার শিক্ষার্থীদের পদাচারণায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

আগামী ১৭ অক্টোবর থেকে সকল বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সশরীরে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর আগেই আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হলো।

মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন 'গণরুম' বন্ধের আশ্বাস দিলেও সিটে ওঠা নিয়ে সংশয়ে আছেন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা, যারা আগে গণরুমে থাকতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি আবাসিক হল ও চারটি হোস্টেলে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থীকে থাকতে হয় ।

আবাসন সঙ্কটের কারণে বেশিরভাগ হলেই সৃষ্টি হয়েছে ‘গণরুমের’, যেখানে বড় হলরুমে মেঝেতে টানা বিছানা পেতে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হত।

কারা এসব কক্ষে থাকবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে। কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি আর কিছু উদ্যোগের পরও এ সমস্যার সমাধান এতদিন হয়নি।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ অক্টোবর হল খোলার পর হল প্রশাসন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু ছাত্রত্ব শেষ- এমন কেউ কেউ আবার ফিরে এসেছেন।

যেসব শিক্ষার্থী হল প্রশাসন থেকে সিট বরাদ্দ পেয়েও উঠতে পারছেন না, তারা নাম প্রকাশ করে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হল প্রশাসন আমাকে একটি রুমে সিট বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু ওই সিটে আমি উঠতে পারছি না। ওই সিটে গেলে সিনিয়র ভাইয়েরা বলছেন তারা এই মুহূর্তে হল ছাড়তে পারবেন না। চাকরির পরীক্ষাসহ নানা অজুহাতে তারা জুনিয়রদের সিট ছাড়ছে না।”

স্যার এ এফ রহমান হলের দ্বিতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “হল প্রশাসন সিট বরাদ্দ দিলেও ছাত্রলীগ নেতাদের প্রভাবে ওই সিটে ওঠা যাচ্ছে না। ছাত্রলীগ নেতারা এলাকাভিত্তিক বা গ্রুপভিত্তিক সিটে উঠতে দেয়।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বৈধতা বা ছাত্রত্ব যাচাই বাছাই করেই হলে উঠতে দিচ্ছে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে যারা হলে উঠছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। শিক্ষার্থীরা হলগুলোতে ওঠার পর নিয়মিত চেক দেওয়া হবে, যাতে অছাত্ররা রুম দখল করে থাকতে না পারে।

“হল প্রশাসন ইতোমধ্যে যেসব আসন ফাঁকা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করেছে এবং ফাঁকা আসনে গণরুমের শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ দিচ্ছে। আশা করি, ছাত্র সংগঠনগুলোও আমাদের সহযোগিতা করবে।"

এদিকে দ্বিতীয় ধাপে সকল বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য হল খোলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সকাল ১০টার দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল এবং রোকেয়া হল পরিদর্শনে যান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে উপাচার্য বলেন, “সকল শিক্ষার্থীকে হলে ওঠানোর ক্ষেত্রে আমাদেরকে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে। একটি হলো করোনা সংক্রমণের হার এবং শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন গ্রহণের অগ্রগতি। দুটিই এখন আশাব্যঞ্জক।

“একদিকে যেমন সংক্রমণের হার কমে আসছে, অপরদিকে আমাদের শিক্ষার্থীরাও অধিকাংশই ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছে। যারা এখনও নেয়নি, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. শহীদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে অস্থায়ী টিকা কেন্দ্র করা হয়েছে। এনআইডি কার্ডের জন্য যারা টিকা নিতে পারছে না, তাদের জন্য টিএসসিতে বুথ স্থাপন করে এনআইডি নিবন্ধনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

১৭ অক্টোবরে সশরীরে ক্লাস শুরুর আগেই শিক্ষার্থীরা সবাই যাতে অন্তত এক ডোজ টিকা নিতে পারেন, সেজন্য সব ব্যবস্থা করার কথা বলেন উপাচার্য।

যেভাবে থাকতে হবে

মহামারীকালে হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকবে, রিডিং রুম , মসজিদ ও  ক্যান্টিন কীভাবে ব্যবহার করবে, সেসব বিষয়ে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর) তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি।

হল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের এই এসওপি মেনে চলতে নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

>> সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত ও সার্বক্ষণিক নিয়মমাফিক নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে। টিকা নেওয়ার পরেও সঠিক নিয়মে মাস্ক পরার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

>> স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরস্পরের কাছ থেকে কমপক্ষে ১ মিটার (৩ ফুট)  শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

>> জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, সংবেদন হ্রাস, মাংসপেশীতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ গোলাপী হয়ে যাওয়া বা গলা ব্যথাসহ অন্যান্য কোভিড ১৯ লক্ষণ থাকলে বাড়ি বা হলের কক্ষে অবস্থান করতে হবে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে কর্তৃপক্ষ।

>> প্রতিটি কাজের আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে, হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা যাবে না। করমর্দন এবং আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

>> যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় হাতের কনুই-এর ভাঁজে বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢাকতে হবে। প্রবেশ ও বহির্গমন পথে ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে এবং দৈহিক তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। ক্লাসরুম, পরীক্ষার হল, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ও অফিসসমূহে পর্যন্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদ্ধতি ও নিয়ম (এসওপি) অনুসরণ করতে হবে।

>> হঠাৎ কেউ অসুস্থতা বোধ করলে অবিলম্বে মেডিক্যাল সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।

>> শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ কক্ষ এবং কক্ষের আশপাশ সবসময় নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং এক্ষেত্রে হল প্রশাসন সহযোগিতা করবে।

>> হল ডাইনিং, ক্যান্টিন, মেস, দোকান, সেলুন, রিডিংরুম, অডিটোরিয়াম, টিভিরুম, অতিধিকক্ষ, পাঠাগার, মসজিদ ও উপাসনালয়ে ভিড় করা যাবে না। এসব স্থানে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বিধি অনুসরণ এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

ডাইনিংয়ে পালা করে খাবার খেতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অতিথিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ বন্ধ রাখতে হবে। বেড়াতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সভা-সমাবেশ, রেস্তোরাঁ, পার্টি ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে হবে।

# চিকিৎসা সংক্রান্ত

কোনো আবাসিক শিক্ষার্থীর দীর্ঘস্থায়ী কোনো অসুখ-বিসুখ (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার,

ডায়াবেটিস প্রভৃতি) থাকলে তা আগেই হল প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানাবেন। হলে অবস্থানকালে কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন এবং সংশ্লিষ্ট আবাসিক শিক্ষককে অবহিত করবেন।

কোনো শিক্ষার্থীর কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী ব্যবস্থাপনার জন্য জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম যেমন- রোগ সনাক্তের জন্য ক্যাম্পাসে নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন, মৃদু লক্ষণ ও লক্ষণবিহীন কোভিড-১৯ রোগীদের আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে।

কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য ক্লাসরুম, ল্যাব, হল, ডাইনং রুম প্রভৃতি স্থানে প্রবেশকারীদের তালিকা লিখিত বা ইলেক্ট্রনিক উপায়ে সংরক্ষণ করতে হবে। ১৪ দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট টিউটরিয়াল গ্রুপে/ক্লাসে/হলের ব্লকে কতজন কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে, রোগতত্ত্ববিদদের সাথে পরামর্শ করে তা ঠিক করতে হবে।

# খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা

>> সুষম খাবার খেতে হবে এবং পরিমাণমত পানি পান করতে হবে, অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে।

>> নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে সচেষ্ট থাকতে হবে, বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা যাবে না, পরিমিত সময় পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে হবে।

>> খেলাধুলায় ও সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন- খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ‘অধিকতর মনোনিবেশ’ করতে হবে; প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করতে হবে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকতে হবে।

>> ক্যান্টিন/ক্যাফেটেরিয়ায় একাধিক গেট থাকলে, একটি গেট প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি বহির্গমনের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

>> ক্যান্টিন/ক্যাফেটেরিয়ায় পালাক্রমে খাবার খেতে হবে। তবে বোতলজাত পানীয় এবং ডিসপোজেবল পাত্রে খাবার সংগ্রহ করে রুমে বসে খাওয়া বেশি নিরাপদ। একই সময়ে কর্মীদের সংখ্যা সীমিত করতে ১০-১৫ মিনিটের ব্যবধানসহ শিফট পরিচালনা করতে হবে।

>> স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে ব্যবহৃত ছুরি-চামচ, খাবারপাত্র, কাপ ইত্যাদি পুনঃব্যবহারের আগে ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ কক্ষ এবং কক্ষের আশপাশ সবসময় নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখতে হবে।

>>হল ডাইনিং, ক্যান্টিন, মেস, দোকান, সেলুন, রিডিংরুম, অডিটোরিয়াম, টিভিরুম, অতিথিকক্ষ, পাঠাগার, মসজিদ ও উপাসনালয়ে ভিড় করা যাবে না। এসব স্থানে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বিধি অনুসরণ এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।