মুখে মাস্ক, কাঁধে ব্যাগ, দেড় বছর পর হলে ফিরছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের পদাচারণায় আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2021, 05:56 AM
Updated : 5 Oct 2021, 05:56 AM

স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘ ছুটির তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে, মুখে মাস্ক, কাঁধে ব্যাগ আর দুহাত ভরা তল্পিতল্পা নিয়ে মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে হলে ফিরতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা।

দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের ফিরে পেয়ে হল প্রাধ্যক্ষরা তাদের রজনীগন্ধা ফুল ও চকলেট দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন।

তবে মহামারীর দিনে সবকিছুই অন্যরকম। করোনাভাইরাসের অন্তত এক ডোজ টিকা নেওয়ার কার্ড এবং হলের পরিচয়পত্র দেখালে তবেই শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।

মহামারীর মধ্যেই মঙ্গলবার সকালে খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো; স্বাস্থ্যবিধির অংশ হিসেবে হাত ধোয়ার জন্য রোকেয়া হলের প্রবেশপথেই বসানো হয়েছে বেসিন। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

হলের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। ভেতরে ঢোকার আগে সবার তাপমাত্রা মেপে দেখা হচ্ছে।

প্রথম ধাপে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা হলে উঠতে পারছেন।

তাদের পরীক্ষা শেষ হলে দ্বিতীয় ধাপে স্নাতক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সকাল ১০টায় বিজয় একাত্তর হল পরিদর্শনে যান।

হলের সার্বিক পরিবেশ ঘুরে দেখার পর তিনি সাংবিাদিকদের বলেন, “আজকে আমাদের জন্য একটি আনন্দের দিন, একেবারে ঈদের দিনের মত। প্রতিটি হলে আনন্দমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হচ্ছে।

“শিক্ষার্থীরা টিকা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শৃঙ্খলার সঙ্গে হলে উঠছে। এই হল, এই ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদেরকে পেয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও একট প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিনের স্থবিরতার অবসান ঘটল।”

মঙ্গলবার সকালে খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো; ট্রলি ব্যাগ হাতে রোকেয়া হলে প্রবেশ করছেন এক শিক্ষার্থী। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

যত দ্রুত সম্ভব অন্য শিক্ষার্থীদেরও হলে তোলা হবে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “সকল শিক্ষার্থীকে হলে ওঠাতে এবং শ্রেণিকক্ষের পাঠদান শুরু করতে আমাদেরকে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে। একটি হল দেশে করোনা সংক্রমণ হার, যেটা এখন একেবারে নিচের দিকে। আরেকটি হল শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা, সেটিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

“দুটিই এখন আশাব্যঞ্জক। আমরা শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডির সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে গত বছরের ১৮ মার্চ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। খালি করে দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও।

সংক্রমণের হার কমে আসায় হল খুললেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সব শিক্ষার্থীকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনার পর সরাসরি ক্লাস শুরুর পরিকল্পনার কথখা এর আগে বলা হয়েছিল। কিন্তু ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৩ হাজার শিক্ষার্থী অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান।

তিনি জানান, প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করে এখন এসএমএসের জন্য অপেক্ষায় আছেন।

দেড় বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। রিকশা ও ভ্যানে করে মালামাল নিয়ে মঙ্গলবার সকালে রোকেয়া হলে উপস্থিত হন শিক্ষার্থীরা। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

মহামারীকালে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রত্যেক হলের প্রবেশপথে বসানো হয়েছে হাত ধোয়ার বেসিন। হলের দেয়ালে নতুন রঙ করা হয়েছে; বাগানে লাগানো হয়েছে ফুলের গাছ। মাঠের ঘাস ছেঁটে ছোট করা হয়েছে।

দীর্ঘদিনের ধুলোয় মলিন ডাইনিং, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া, রিডিং রুম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। টয়লেট ও বাথরুমগুলো পরিষ্কার করার পাশাপাশি কোনো কোনো হলে সংস্কারও করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ছাড়াও কোনো কোনো হলে আলাদাভাবে আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে।

মহামারীকালে হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকবে, রিডিং রুম, মসজিদ ও ক্যান্টিন কীভাবে ব্যবহার করবে, তা নিয়ে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর) তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি।

মহামারীর কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। রোকেয়া হলের এই শিক্ষার্থী তার পোষা পাখি নিয়েই ফিরেছেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

হল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের এই এসওপি মেনে চলতে নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

# যেভাবে থাকতে হবে

মহামারীকালে হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকবে, রিডিং রুম , মসজিদ ও  ক্যান্টিন কীভাবে ব্যবহার করবে, সেসব বিষয়ে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর) তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি।

হল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের এই এসওপি মেনে চলতে নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

>> সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত ও সার্বক্ষণিক নিয়মমাফিক নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে। টিকা নেওয়ার পরেও সঠিক নিয়মে মাস্ক পরার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

>> স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরস্পরের কাছ থেকে কমপক্ষে ১ মিটার (৩ ফুট)  শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

>> জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, সংবেদন হ্রাস, মাংসপেশীতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ গোলাপী হয়ে যাওয়া বা গলা ব্যথাসহ অন্যান্য কোভিড ১৯ লক্ষণ থাকলে বাড়ি বা হলের কক্ষে অবস্থান করতে হবে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে কর্তৃপক্ষ।

>> প্রতিটি কাজের আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে, হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা যাবে না। করমর্দন এবং আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

>> যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় হাতের কনুই-এর ভাঁজে বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢাকতে হবে। প্রবেশ ও বহির্গমন পথে ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে এবং দৈহিক তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। ক্লাসরুম, পরীক্ষার হল, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ও অফিসসমূহে পর্যন্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদ্ধতি ও নিয়ম (এসওপি) অনুসরণ করতে হবে।

>> হঠাৎ কেউ অসুস্থতা বোধ করলে অবিলম্বে মেডিক্যাল সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।

>> শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ কক্ষ এবং কক্ষের আশপাশ সবসময় নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং এক্ষেত্রে হল প্রশাসন সহযোগিতা করবে।

>> হল ডাইনিং, ক্যান্টিন, মেস, দোকান, সেলুন, রিডিংরুম, অডিটোরিয়াম, টিভিরুম, অতিধিকক্ষ, পাঠাগার, মসজিদ ও উপাসনালয়ে ভিড় করা যাবে না। এসব স্থানে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বিধি অনুসরণ এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

ডাইনিংয়ে পালা করে খাবার খেতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অতিথিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ বন্ধ রাখতে হবে। বেড়াতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সভা-সমাবেশ, রেস্তোরাঁ, পার্টি ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে হবে।

# চিকিৎসা সংক্রান্ত

কোনো আবাসিক শিক্ষার্থীর দীর্ঘস্থায়ী কোনো অসুখ-বিসুখ (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার,

ডায়াবেটিস প্রভৃতি) থাকলে তা আগেই হল প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানাবেন। হলে অবস্থানকালে কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন এবং সংশ্লিষ্ট আবাসিক শিক্ষককে অবহিত করবেন।

কোনো শিক্ষার্থীর কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী ব্যবস্থাপনার জন্য জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম যেমন- রোগ সনাক্তের জন্য ক্যাম্পাসে নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন, মৃদু লক্ষণ ও লক্ষণবিহীন কোভিড-১৯ রোগীদের আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে।

কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য ক্লাসরুম, ল্যাব, হল, ডাইনং রুম প্রভৃতি স্থানে প্রবেশকারীদের তালিকা লিখিত বা ইলেক্ট্রনিক উপায়ে সংরক্ষণ করতে হবে। ১৪ দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট টিউটরিয়াল গ্রুপে/ক্লাসে/হলের ব্লকে কতজন কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে, রোগতত্ত্ববিদদের সাথে পরামর্শ করে তা ঠিক করতে হবে।

# খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা  

>> সুষম খাবার খেতে হবে এবং পরিমাণমত পানি পান করতে হবে, অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে।

>> নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে সচেষ্ট থাকতে হবে, বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা যাবে না, পরিমিত সময় পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে হবে।

>> খেলাধুলায় ও সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন- খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ‘অধিকতর মনোনিবেশ’ করতে হবে; প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করতে হবে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকতে হবে।

>> ক্যান্টিন/ক্যাফেটেরিয়ায় একাধিক গেট থাকলে, একটি গেট প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি বহির্গমনের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

>> ক্যান্টিন/ক্যাফেটেরিয়ায় পালাক্রমে খাবার খেতে হবে। তবে বোতলজাত পানীয় এবং ডিসপোজেবল পাত্রে খাবার সংগ্রহ করে রুমে বসে খাওয়া বেশি নিরাপদ। একই সময়ে কর্মীদের সংখ্যা সীমিত করতে ১০-১৫ মিনিটের ব্যবধানসহ শিফট পরিচালনা করতে হবে।

>> স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে ব্যবহৃত ছুরি-চামচ, খাবারপাত্র, কাপ ইত্যাদি পুনঃব্যবহারের আগে ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ কক্ষ এবং কক্ষের আশপাশ সবসময় নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখতে হবে।

>>হল ডাইনিং, ক্যান্টিন, মেস, দোকান, সেলুন, রিডিংরুম, অডিটোরিয়াম, টিভিরুম, অতিথিকক্ষ, পাঠাগার, মসজিদ ও উপাসনালয়ে ভিড় করা যাবে না। এসব স্থানে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বিধি অনুসরণ এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।