করোনাভাইরাস মহামারীকালে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর একদিন বাদেই খুলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।
মঙ্গলবার সকালে শিক্ষার্থীরা এলে তাদের বরণের প্রস্তুতিও নেওয়া সারা বলে জানান অধ্যাপক বাছির, যিনি বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন।
“তাদেরকে আনন্দপূর্ণ পরিবেশে বরণ করে নিতে আমাদের হলে আমরা রজনীগন্ধা ফুল, চকলেট, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করছি। অন্যান্য হলের প্রভোস্টদের কাছেও সেই মেসেজটা পাঠানো হয়েছে।”
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও খালি করে দেওয়া হয়।
দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৯টি হল ও চারটি হোস্টেলে ২৬ হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকছে, যদিও এগুলোর শিক্ষার্থী ধারণ ক্ষমতা এর প্রায় অর্ধেক।
স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘ ছুটিতে সেই শিক্ষার্থীদের যে আবাসন নিয়ে যে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল, তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে মঙ্গলবার।
তবে মহামারীর অবসান এখনও না হওয়ায় সব শিক্ষার্থী এথনই হলে উঠতে পারছে না। ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের হলে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
হলে লেগেছে রঙ, ঝকঝকে ডাইনিং-ক্যান্টিন
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রত্যেক হলের প্রবেশপথে বসানো হয়েছে হাত ধোয়ার বেসিন। হলের দেয়ালে নতুন রঙ, বাগানে নতুন ফুলগাছ ও মাঠের ঘাস কেটে ছোট করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের ধুলোয় মলিন ডাইনিং, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া, রিডিং রুম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। টয়লেট ও বাথরুমগুলো পরিষ্কার করার পাশাপাশি কোনো কোনো হলে সংস্কারও করা হয়েছে।
অধ্যাপক আবদুল বাছির বলেন, “হলের সার্বিক পরিবেশ, খাবারের ক্যান্টিন, ডাইনিং, রিডিং রুম, সেলুনসহ সব কিছু আমরা পরিদর্শন করেছি। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার্য চেয়ার-টেবিল সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।”
ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহ মো. মাসুম বলেন, “শিক্ষার্থীদের খাবারের সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতে আমদের হলের ক্যান্টিন ও খাবারের দোকানগুলোকে সংস্কার করা হয়েছে।
“আগের মতো আর খোলা জায়গায় যেখানে সেখানে খাবার বিক্রির সুযোগ পাবে না কেউ। হলের ভেতর দূরত্ব বজায় রেখে দুটি দোকান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ক্যান্টিনটাকে টাইলস করা হয়েছে, সেখানে খাবার সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য গ্লাস করে বক্স বানানো হয়েছে।”
“আগের চেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে হলে। আশা করি, দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীরা এই পরিবেশ দেখে খুশি হবে,” বলেন তিনি।
কারা কীভাবে উঠছে
মঙ্গলবার প্রথম ধাপে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা হলে উঠতে পারবে।
সকাল ৮টা থেকে হলে উঠতে পারবে শিক্ষার্থীরা, ঢুকতে হলে নিজেদের পরিচয়পত্রের সঙ্গে কোভিড-১৯ টিকার কার্ড সঙ্গে নিতে হবে, আর অন্তত এক ডোজ টিকা নেওয়া থাকতে হবে।
তাদের পরীক্ষা শেষ হলে নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে স্নাতক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাকিয়া পারভীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধির অংশ হিসেবে তাপমাত্রা মেপে, মাস্ক পরিয়ে ও হ্যান্ডস্যানিটাইজ ব্যবহার করিয়ে শিক্ষার্থীদের হলে ঢোকানো হবে। মহামারীকালে কীভাবে হলে থাকবে, সেজন্য নির্দেশনাবলি টানানো থাকবে।
কোনো শিক্ষার্থীর জ্বর বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে আইসোলেশনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক জাকিয়া পারভীন।
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ও শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রকে আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হলের মধ্যেও আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখছি।”
গণরুম থাকবে না
আবাসন সমস্যার কারণে সৃষ্ট দীর্ঘদিনের ‘গণরুম’ ব্যবস্থা এবার মহামারীতে বিলোপ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এই প্রথা থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বেশিরভাগ হলেই ‘গণরুমের’ নামে বড় হলরুমে মেঝেতে টানা বিছানা পেতে প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হত।
কারা এসব কক্ষে থাকবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে। কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি আর কিছু উদ্যোগের পরও এ সমস্যার সমাধান এতদিন হয়নি।
এখন মহামারীর মধ্যে হল খোলার আগে ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে এবং হলগুলোতে যাতে বৈধ শিক্ষার্থীরাই থাকে, তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ১৩টি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর পরিবেশ কমিটির সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে হল খোলার আগেই কয়েকটি হলে একদল শিক্ষার্থী জোর করে হলে উঠে পড়েছেন। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও রয়েছে।
মঙ্গলবার হলগুলোতে শুধু স্নাতক চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের উঠানোর কথা থাকলেও সেখানে অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সে নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ অক্টোবর সকাল ৮টা থেকে আমরা শুধু অনার্স ফাইনাল ইয়ার ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার অনুমতি দিচ্ছি। আমরা বিষয়টি গত দুই মাস ধরে প্রচার করেছি।
“এখন ভিন্ন পরিস্থিতিতে হল খোলা হচ্ছে, বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মাথায় রাখতে হবে। হল প্রশাসন বিষয়গুলো কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ- এমন কেউ হলে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
# যেভাবে থাকতে হবে
# খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা |
শ্রেণিকক্ষে ক্লাস কবে শুরু?
সংক্রমণের হার কমে আসায় হল খুললেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সব শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় এলে সরাসরি ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া ছিল।
মোট ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে বর্তমানে ২৩ হাজার শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান।
তিনি সোমবার বলেন, “এপর্যন্ত আমরা প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর অন্তত এক ডোজ টিকা গ্রহণের তথ্য পেয়েছি। প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী সুরক্ষায় নিবন্ধন করে এখন এসএমএসের জন্য অপেক্ষায় আছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “আমরা একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের সভায় এ সম্পর্কে আলোচনা করে একটি রোডম্যাপ দিয়েছি। সব শিক্ষার্থী টিকার আওতায় আসলে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান শুরু হবে। এর আগে অনলাইন-অফলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা চলবে।”
মঙ্গলবার সকালে হল খোলার পর বিভিন্ন হল পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান তিনি।