কোভিড-১৯ টিকা কবে পাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা?

শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করার আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার সিদ্ধান্তে সেশনজটে পড়ে চাকরির বয়স নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিও রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2021, 08:17 PM
Updated : 24 May 2021, 08:17 PM

সবাইকে দ্রুত টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত খুলে দেওয়ার দাবি শিক্ষার্থীরা তুলেছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ লাখ টিকার বন্দোবস্তু করে কবে নাগাদ তা দেওয়া যাবে, তাও এখন বলতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর মধ্যে তারা এক বছর পিছিয়ে পড়েছেন। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে আরও এক বছরের সেশনজটে পড়তে হবে তাদের।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার লক্ষ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।

আর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বা পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে জাতীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর সরকারি সিদ্ধান্তে গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বন্ধ।

সংক্রমণের নিম্নগতির মধ্যে গত ২২ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, রোজার ঈদের পর ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলবে।

কিন্তু বাদ সাধে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। সেজন্য পরিকল্পনা তো বাদ দিতে হয়েছেই; কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে, তাও পড়েছে অনিশ্চয়তায়।

এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সুভদ্র দেবনাথ বলেন, “বিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় এনে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া উচিত।

“আর সব ধরনের চাকরির আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে ৩১ মার্চের মধ্যে শিক্ষার্থীদের টিকার জন্য নিবন্ধন করতে বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সেখানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। ১৭ এপ্রিলের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রথম ডোজ দিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

তখন কেন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হল না, সে প্রশ্ন রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শৈবাল রায়।

“তখন তো দেশে টিকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবাই টিকা নিয়েছেন ঠিকই, শিক্ষার্থীদের টিকা নিয়ে কেন তালবাহনা? টিকা নামক মুলা ঝুলিয়ে কি এবছরটাও পার করে দেওয়া হবে?”

টিকা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী ইয়াছিন আল শাহীন।

“বলা হয়েছে, টিকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হবে। কিন্তু টিকা আমরা কবে পাব?

টিকার অজুহাত দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের তারিখ বার বার পেছানো হচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষা জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে তাদের টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অমর্ত্য রায় বলেন, “একেবারে ভ্যাক্সিন আসার সাথে সাথেই আমরা দাবি জানিয়েছিলাম যাতে আমাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে অনেকেই টিকা নিয়েছে।”

খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধনে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসান জানিয়েছেন, টিকার জন্য বেশ আগেই তালিকা পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

“সরকারের উচিৎ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় এনে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া।”

অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাকির মাহমুদ বলেন, “টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে রাখলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাসীনতা দেখে আমরা হতাশ।”

মহামারী না এলে গত বছরই স্নাতক করে ফেলতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী শিরিনা আক্তার।

দ্রুত আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “এবছরও যদি পরীক্ষাগুলো না দিতে পারি, তাহলে চাকরি, বয়স ও নানা জটিলতায় জীবন অনিশ্চিত গন্তব্যে যাবে।”

টিকা না পেলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি অনেকের হলেও কেউ কেউ টিকা নিশ্চিত করার আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিপক্ষে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী পার্থ কাজুড়ী বলেন, “আমরা কঠিন সময় পার করছি। আর ভ্যাকসিনের ঘাটতি থাকায় সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন দেওয়ার দাবি করাটাও আমার কাছে যৌক্তিক না।

“তারপরও যতদিন শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত না করা যায়, ততদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। কারণ শিক্ষার চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি।”

কী বলছে কর্তৃপক্ষ?

বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের আবাসিক-অনাবাসিক সব শিক্ষার্থীর তালিকা পাঠিয়েছি। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী যার যার অবস্থান থেকে রেজিস্ট্রেশন করে ভ্যাকসিন পেয়েও গেছে। সবাই যাতে ভ্যাকসিনের আওতায় আসে, সেজন্য আমরা ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ রাখছি।”

এদিকে টিকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ।

তিনি বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কোনো আবাসিক সুবিধা নাই। সেক্ষেত্রে আমরা ইউজিসিকে চিঠি লিখেছি, আমাদের কী করণীয় জানতে। এটার রিপ্লাই এখনও আসেনি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও দাবি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদেরও যাতে দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়, সেজন্য আমরা মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর অনুরোধ জানিয়ে আজকেও (সোমবার) একটি চিঠি পাঠিয়েছি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষক-কর্মকর্তারা সুরক্ষা পেয়েছেন, ধীরে ধীরে সবাই পাবে। আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে তা নির্ভর করছে টিকা পাওয়ার উ্পর।

“ভ্যাকসিন যত দ্রুত পাওয়া যাবে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়েও তত দ্রুত অগ্রসর হতে পারব, শিক্ষা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে পারব।”

টিকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অন্তর্ভুক্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর তালিকা পাঠানের কথা জানিয়েছেন ইউজিসি সদস্য দিল আফরোজা বেগম।

তিনি বলেন, “আমরা কোনো উদ্যোগ তো নিতে পারি না, সব শিক্ষার্থীর লিস্ট পাঠিয়ে দিয়েছি। উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দিতে হলে মোটামুটি ১০ লক্ষ ডোজ নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে যদি সরকার একটু বেশি প্রায়োরিটি দেয়, কারণ হায়ার এডুকেশনে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাটা একটু কঠিন হয়ে যায়।”

মহামারীর প্রথম ঢেউ সামাল দেওয়ার মধ্যেই গত বছরের নভেম্বরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে চুক্তি করে বাংলাদেশ।

দুই চালানে সেরাম ইনস্টিটিউট ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাঠানোর পর ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়ে। ফলে টিকাদান কর্মসূচিতে প্রথম ডোজ দেওয়া এপ্রিলেই বন্ধ করে দিতে হয়। এখন শুধু দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলেও তাও ফুরিয়ে গেছে প্রায়।  

সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা না পেয়ে চীন ও রাশিয়ার টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চীনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে সিনোফার্মের ৫ লাখ ডোজ টিকা ইতোমধ্যে এসেছে।

তবে শিক্ষার্থীরা কবে টিকা পাবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন তো ভ্যাকসিন নেই, ভ্যাকসিন আসলেই আমাদের জাতীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে, কবে কীভাবে তাদের টিকা দেওয়া হবে।”