আদিল মাহবুবের মত বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রতিবন্ধকতামুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটা সময়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা ছিলো দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন তা বদলাচ্ছে।
ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (পিডিএফ) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ৮০ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়ছেন। তাদের মধ্যে ছয় জনকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, অ্যাকাডেমিক ও আবাসিক ভবনগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়ায় প্রতিটি দিন অন্য এক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এই শিক্ষার্থীদের। যেসব ভবনে লিফট, র্যাম্প বা স্লোপ নেই সেখানে হুইল চেয়ার নিয়েও যাওয়া যায় না। এমনকি এসব ভবনের অধিকাংশ টয়লেটও প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়।
শিক্ষক যখন ক্লাস নেন, অনেক সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রটির কথা হয়ত তার মনে থাকে না। পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক পাওয়াও তাদের জন্য একটি সংকট।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতিটা প্রতিবন্ধীর চ্যালেঞ্জ আলাদা। যে চোখে দেখতে পায় না, তার জন্য পৃথিবীর অর্থ এক রকম, যে চলাফেরা করতে পারে না, তার জন্য এ পৃথিবী আলাদা অর্থ বহন করে।”
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে সাকিব বলেন, “প্রতিবন্ধীদের সর্বত্র প্রবেশগম্যতা নেই। সব সময় তাকে নেতিবাচক চিন্তাভাবনার শিকার হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত সমস্যা প্রতিনিয়ত তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
“একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যদি একটা ক্লাসরুমে থাকে, তখন যদি লেকচার দেয়ার সময় শিক্ষক স্লাইড ব্যবহার করেন, সারপ্রাইজ টেস্ট নেন- আমাদের জন্য সেটা কষ্টকর হয়ে যায়।”
সাকিব আক্ষেপ করে বলেন, “একজন সাধারণ শিক্ষার্থীকে নিয়ে একজন শিক্ষকের যেরকম আশা আকাঙ্ক্ষা থাকে, তার ভবিষ্যত নিয়ে যেমন দৃষ্টিভঙ্গি তিনি পোষণ করেন, একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি সেটা থাকে না। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে তাদের চোখের আশার আলো যেন আপনা-আপনি নিভে যায়।”
বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আদিল মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হুইল চেয়ারকে জীবনের সঙ্গী করে। সঙ্গত কারণেই হলে তার প্রয়োজন ছিল নিচতলার কোনো কক্ষ। ভর্তির পর তাকে মুহসীন হলের নিচতলাতেই উঠতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির চক্করে সেই সিটে তিনি উঠতে পারছিলেন না।
"অটোমেটিক হুইল চেয়ার পাওয়ায় এখন আর আমাকে অতটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। খাওয়া-দাওয়া, ক্লাসে যাওয়া কিংবা চলাফেরা নিজেই করতে পারি। অনেক সময় লিফট না থাকলে কিংবা র্যাম্প না থাকলে বন্ধুদের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু লেকচার থিয়েটার ভবনে র্যাম্প বা স্লোপ নেই, ওইখানে ক্লাসগুলো করা হয় না।”
'সেরিব্রাল পালসি'তে আক্রান্ত হৃদয় সরকার গতবছর যখন মায়ের কোলে চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, সেই ছবি আর খবর সামাজিক যোগাযোগের ভাইরাল হয়েছিল। এখন তিনি আজিমপুরে মায়ের কাছেই থাকেন, প্রতিদিন ক্যাম্পাসে এসে ক্লাস করে যান।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিভঙ্গী এবং সুযোগ সুবিধা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী রয়েছে নানা অভিযোগ।
“আমার মতে, এখনও নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। তবু চিবল দা’র মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রয়োজনের দিকগুলো, আমাদের কথাগুলো প্রশাসনের কাছে তুলে ধরার একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। সে কারণে আমরা একটি প্রতিবন্ধকতামুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখতে পারি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন- বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবনে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে হুইল চেয়ারে চলাচলকারীদের জন্য র্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে, কয়েকটি আবাসিক হলে প্রতিবন্ধীবান্ধব ওয়াশরুমের কাজ চলছে।
“তবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক পাওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এখনও। যেসব জায়গায় লিফটের ব্যবস্থা নেই, বিশেষ করে রেজিস্ট্রার ভবনে কাজ থাকলে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।”
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, কলা ভবন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, রেজিস্ট্রার ভবন, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, মুহসীন হল, জগন্নাথ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল এবং টিএসসিতে হুইল চেয়ারের জন্য কয়েকটি র্যাম্প ও স্লোপ তৈরি করা হয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রে তা ব্যবহার উপযোগৗ হয়নি বলে জানালেন চিবল।
“এইগুলো তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ প্রকৌশলীর মতামত নেওয়া হয়নি। কয়েকটি র্যাম্পে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। ফলে ম্যানুয়াল হুইলচেয়ার চালিয়ে ওঠা বা নামা কঠিন, কখনও কখনও এটা ঝুঁকিপূর্ণ।”
তবে অন্যদের মানসিকতাও যে একটি বড় সমস্যা, সে কথাও বললেন শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার এই শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।
আবাসিক হলগুলোতে বাইক স্ট্যান্ড তৈরি হয়ে গেলে, সবাই সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করলে, সকলের সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন চিবল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ভবনের কাজ হবে, সবগুলোই প্রতিবন্ধীবান্ধব ভবন নির্মাণের নিয়ম-কানুন মেনে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা জায়গা, যেটা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক পাওয়ার সঙ্কট নিয়ে প্রশ্ন করলে উপাচার্য বলেন, “এই ব্যাপারটি আসলে দেখতে হবে প্রয়োজনের ভিত্তিতে। কার আসলেই শ্রুতিলেখক প্রয়োজন, কার শ্রুতিলেখকের প্রয়োজন নেই, সেটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হলে অপব্যবহারের বিষয়টি এড়ানো সম্ভব।”
হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি র্যাম্পের জায়গায় গাড়ি কিংবা বাইক রাখার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আখতারুজ্জামান বলেন, “র্যাম্পের জায়গাগুলোতে সচেতনতা অবলম্বনের জন্য অতি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মূলত র্যাম্প তৈরির ক্ষেত্রে জায়গা নির্ধারণে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবের কারণে এমনটা হয়েছে।
“তবে আমরা যারা শারীরিকভাবে সক্ষম, তাদের সচেতনতার বিষয়টি নিজ নিজ জায়গা থেকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রতিবন্ধকতামুক্ত হবে বলে আশা করা যায়।”